ময়ূরেশ্বরের দাঁড়কান্দি গ্রামে চলছে আদিবাসী নাচের প্রশিক্ষণ। —নিজস্ব চিত্র।
পরনে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ। আবহে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’। সেই কথা ও সুরের ছন্দেই নেচে উঠবে মুঙ্গলি, মনিকা, দুলি, শুসুমণিরা। ওরা বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের জনা কুড়ি আদিবাসী কিশোরী।
আজ, ২৫ শে বৈশাখ ‘রবীন্দ্র-জয়ন্তী’তে গ্রামের কালীতলায় খোলা জায়গায় জীবনে প্রথম ‘গুরুদেবে’র গানে ‘রবীন্দ্র-নৃত্য’ পরিবেশন করবে স্থানীয় ষাটপলশা হাইস্কুলের ওই ছাত্রীরা। আর তার জন্যই গত ন’মাস ধরে দিনরাত এক করে নাচের মহড়া দিয়ে আসছে শুসুমণিরা। গোটা বিষয়টির যৌথ উদ্যোক্তা সল্টলেকের ‘শর্মিষ্ঠা কালচারাল ইউনিট’ এবং সাঁইথিয়ার ‘নীলমেঘ অ্যাকাডেমি’। মূল উদ্দেশ্য আদিবাসী, তফসিলি জাতি ও উপজাতি মেয়েদের মধ্যে রবীন্দ্র-ভাবনা প্রচার করা। আর তারই জন্য গত সেপ্টেম্বর থেকে স্থানীয় ষাটপলশা পঞ্চায়েতের দাঁড়কান্দি, গোডাউন প্রভৃতি গ্রামের জনা কুড়ি আদিবাসী মেয়েদের নিয়ে চলছে রবীন্দ্রনৃত্যের এই বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবির।
রবীন্দ্রনৃত্যের প্রশিক্ষণে সামিল মুঙ্গলি হেমব্রম, মনিকা হেমব্রম, দুলি হেমব্রম, মুঙ্গলি সোরেন, পুতুল কিস্কু, আশা চড়ে, শুসুমণি বাস্কি, মৌসুমী হাঁসদা, পিঙ্কি ভল্লা, সনকা বাগদিরা প্রত্যেকেই দিনমজুরের কাজ করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করে। পড়াশোনার খরচের পরে যা বাঁচে, তুলে দেয় সংসারের খরচের জন্য। কাজের ফাঁকেই সময় বের করে চলে যায় গ্রামের কাছেই ষাঠপলশা হাইস্কুলে। অবসর, বিনোদন বলতে মধ্যে মাঝে কারও বাড়ি গিয়ে টিভি দেখা আর কাছেপিঠে কোনও নাচ-গানের অনুষ্ঠান হলে, সেখানে যাওয়া। সেখানে রবীন্দ্রনৃত্যের এই প্রশিক্ষণ তাদের প্রত্যেকের জীবনে এক অন্য রকমের আলো এনেছে বলেই মনে করছেন সংস্থার ডিরেক্টর শর্মিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায় এবং ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর দেবগোপাল মণ্ডল। তাঁরা বলছেন, ‘‘মুঙ্গলিদের জীবনে নাচ শেখার প্রথম পাঠ হিসাবে আমরা বেছে নিয়েছি রবীন্দ্রনৃত্যকেই। এই নৃত্য প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে আমরা ওদের আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, মানসিক বিকাশ আরও বলিষ্ঠ করার চেষ্টা করছি। যাতে নিজস্ব প্রতিভা ও দক্ষতা দিয়ে প্রত্যেকেই সমাজে ওদের গড়পরতা জীবনের বাইরে গিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ওরাই ভবিষ্যতে নিজেরাই শিখিয়ে আরও অনেককে স্বনির্ভরতার পথ দেখাবে।’’ ভবিষ্যতে ওই আদিবাসী মেয়েদের নাটক শেখানোরও পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থার।
এ রকম একটি উদ্যোগের সঙ্গে ওই মেয়েদের যুক্ত করা কিন্তু কোনও সহজ কাজ ছিল না। দাঁড়কান্দি গ্রামেরই দুই আদিবাসী যুবকও এই প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িয়ে। সেই সঞ্জিত ভল্লা ও খোকন ভল্লা বলছেন, ‘‘এমনিতেই ওরা খুব লাজুক প্রকৃতির এবং রক্ষণশীল মনোভাবের। তাই তাদের এবং অভিভাবকদের বুঝিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য রাজি করানোটা খুবই কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু, দিনের পর দিন তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়ে দু’এক জনের পরিবারের লোকেদের রাজি করাতে সক্ষম হই আমরা। পরে ওদের দেখেই বাকিরা নিজেরাই নাচ শেখানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। পরিবারের লোকেদের রাজি করিয়ে তাদেরও শিবিরে নিয়ে আসি।’’ তার পরে গ্রামেই একটি ফাঁকা জমিতে মেয়েদের রবীন্দ্রনাথের ঋতুরঙ্গের গান নাচ শেখার হাতেখড়ি হয়। প্রশিক্ষক সংস্থা ‘নীলমেঘ অ্যাকাডেমি’র কর্ণধার অভিজিৎ চৌধুরী জানালেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য হল সংস্কৃতির মাধ্যমে তফসিলি জাতি ও উপজাতি এবং পিছিয়ে পড়া মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘‘এখানকার মাঠেঘাটে মেয়েরা প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। তাই তারা খুব গভীর ভাবে বুঝতে পারে প্রকৃতিকে। উপলব্ধি করতে পারে প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তন। সেই জন্য রবীন্দ্রনাথের ঋতু পর্যায়ের গানই নাচের জন্য বেছে নিয়েছি।’’
ছ’টি ঋতুর ছ’টি গানে ওই মেয়েরা নাচবে। নাচের কোরিওগ্রাফিতেও উঠে এসেছে তাদের বাস্তব জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতা। আজ, শনিবার গ্রামে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথম ওরা নাচবে। প্রশিক্ষণ শেষে বীরভূমের বিভিন্ন প্রান্তের পাশাপাশি কলকাতাতেও তারা অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাবে। অনুষ্ঠান করে পাবে উপযুক্ত সাম্মানিকও। দুলিদের নৃত্য প্রশিক্ষক সারিকা মণ্ডল এবং গার্গী সাহা বলছেন, ‘‘ওদের মধ্যে ইচ্ছা ও প্রতিভা আছে। আমাদের শুধু একটু এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার পথটা একটু দেখিয়ে দিতে হবে। তা হলেই ওরা বাকিটা পথ নিজেরাই এগিয়ে যেতে পারবে।’’ নিজের স্কুলের মেয়েদের এই উদ্যোগে সামিল হতে দেখে উচ্ছ্বসিত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কালীসাধন মণ্ডল। তাঁর আশ্বাস, ‘‘আমি ও আমার স্কুলের সমস্ত শিক্ষকেরা যে কোনও প্রয়োজনে সব সময় ওদের পাশে আছি। ওরা আত্মমর্যাদার সঙ্গে নিজেদের পায়ে দাঁড়াক, এটাই আমাদের কাম্য। ওরা স্কুলে কোনও অনুষ্ঠান করতে চাইলে, তার ব্যবস্থাও স্কুল থেকে করে দেব।’’
প্রতি বুধবার দুপুর যত বিকেলের দিকে গড়িয়ে আসে, ততই ঘরে ফেরার টান বাড়তে থাকে ওদের। কোনও রকমে একটু স্নান খাওয়া সেরে সোজা ছোটে নাচের স্কুলে। গত ৯ মাস ধরে এই রুটিন বদলায়নি আশা চড়েদের। প্রথম অনুষ্ঠানের ২৪ ঘণ্টা আগে সামান্য টেনশনেও রয়েছে তারা। কিন্তু, সমান উত্তেজিতও। শুক্রবার ওরা বলল, ‘‘পেটের দায়ে দিনমজুরে কাজ করি। আমরা আগে শুধু অন্যদের নাচই দেখেছি। আমাদেরও যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সঙ্গে নাচার সুযোগ হবে, অন্যদের মতো ভাল রঙিন শাড়ি, চুড়িদার পরে স্টেজে নাচব, লোকেরা আমাদের নাচ দেখতে আসবে, তা কোনও দিনই ভাবিনি। দিদিমণিদের জন্যই একটা নতুন দিশা পেলাম।’’
দিনমজুরের দিন পেরিয়ে এখন শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে মুঙ্গলিরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy