মেলার আগের প্রস্তুতি। নিজের শিল্পকর্মে শেষ ছোঁয়া ডোকরা শিল্পীর। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
বিকনার শিল্পডাঙায় এখন সাজো সাজো রব! সকাল থেকে রাত, চরম ব্যস্ততা শিল্পীদের মধ্যে। অনেকেই নাওয়া খাওয়া শিকেয় তুলে কাজ করে চলেছেন নাগাড়ে। এমনিতে দেশ বিদেশে ডোকরা শিল্পের খ্যাতির জেরে বাঁকুড়ার এই শিল্পডাঙা তথা ডোকরা গ্রামের নাম সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে। এখানকারই ডোকরা শিল্পী যুদ্ধ কর্মকার তাঁর হাতের জাদুর কেরামতির জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও। কয়েকমাস আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। এ বার সেই যুদ্ধবাবুর কর্মক্ষেত্র এই শিল্পগ্রামে শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে ‘ডোকরা মেলা’। তা নিয়েই চরম ব্যস্ত যুদ্ধবাবুর সঙ্গীরা।
ইউনেস্কো ও রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প দফতরের উদ্যোগে শুরু হতে চলেছে তিনদিনের ডোকরা মেলা। শিল্পডাঙার প্রতিটি ঘরে ঘরে হবে স্টল। যেখানে দেখা মিলবে ডোকরা শিল্প সম্ভারের। গ্রাম সংলগ্ন মাঠে গড়া হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ। সদ্য প্রয়াত এখানকার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী যুদ্ধবাবুর নামেই এই মঞ্চকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে মেলা কমিটি। যাতে বাড়তি উদ্দীপনা পেয়েছেন গ্রামের শিল্পীরা। সব মিলিয়ে শারদ উৎসবের আগেই এক নতুন উৎসব এসে উপস্থিত শিল্পডাঙায়!
এতে পুজোর মরসুমে যেমন বেচা কেনার সুযোগ থাকছে, তেমনই আবার বাইরের মার্কেট ধরতেও বড় ভূমিকা নিতে পারে এই মেলা। ফলে শিল্পীরা কোনও মতেই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন। নিজেদের সেরাটুকু দিতে দিনরাত এক করে খাটছেন তাঁরাও।
বুধবার শিল্পডাঙায় গিয়ে শিল্পীদের সেই ব্যস্ততার ছবিই চোখে পড়ল। গ্রামের আটচালায় বসে এক ঝাঁক শিল্পী নিজের কাজে ব্যস্ত। ডোকরা শিল্পে বরাবরই বাড়ির মহিলারাও পুরুষদের সাহায্য করেন। তারও ব্যতিক্রম নেই। বহু গৃহিনীই স্বামীর পাশে বসে কাজ করছেন বাড়ির রান্না ফেলে এসে। ভ্যাপসা গরমে ঘেমে নেয়ে শিল্পীরা একশা হলেও চোখ স্থির! আটচালায় দেখা হল যুদ্ধবাবুর সেজো ছেলে মঙ্গল কর্মকারের সঙ্গে। মেলা নিয়ে একরাশ আবেগ ঝরে পড়ল তাঁর গলায়। বললেন, “এমন অনুষ্ঠান আগে কখনও হয়নি আমাদের এখানে। এর আগে বহু মেলায় ডোকরা নিয়ে গিয়েছি আমরা গ্রামের শিল্পীরা। তবে এবার খাস বাড়িতেই হবে স্টল। মানুষের ঢল নামবে গ্রামে। আমরা সবাই মুখিয়ে আছি তিনটি দিনের জন্য।”
যুদ্ধবাবুর বড় ছেলে সাধন কর্মকারকে সমানে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী রূপি কর্মকার। এই দম্পতি এখন সংসারের কাজে সময়ই বেশি দিতে পারছেন না ডোকরার মুর্তি গড়ার চাপে। গ্রামের বুদ্ধদেব কর্মকারও স্ত্রী বুলু কর্মকারকে নিয়ে আটচালায় ব্যস্ত। শিল্পীরা জানাচ্ছেন, ডোকরার কাঁচা মাল পিতল, মোম, ধুনো, কয়লার দাম ইদানীং কিছুটা কমায় আয় বেড়েছে। বিক্রি-বাটাও খারাপ হচ্ছে না। এই মেলা বাড়তি অক্সিজেন দিতে পারে বলেই আশা করছেন তাঁরা।
গ্রামের ডোকরা শিল্পী তথা বাঁকুড়া বিকনা ডোকরা হস্তজাত কুটির শিল্প কল্যাণ সমিতির কোষাধ্যক্ষ হরেন্দ্রনাথ রানা বলেন, “খাদি দফতর থেকে সমিতিকে পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। ওই টাকায় বহু শিল্পীরই সমস্যা মিটেছে। নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই শিল্প। এই পরিস্থিতিতে এখানে মেলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় শিল্পীরা খুবই উৎসাহিত হয়েছেন।” মেলা কমিটির প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটার নির্মাল্য রায় বলেন, “ডোকরার প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণের শেষ নেই। মেলা দেখতে তাই মানুষের ঢল নামবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক মঞ্চও থাকছে। যুদ্ধবাবুর নামেই সেই মঞ্চ আমরা উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
জেলা পরিষদের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্প দফতরের কর্মাধ্যক্ষ সুখেন বিদের কথায়, “ডোকরা শিল্পকে পুনরুর্জীবিত করতে নানা পদক্ষেপ করছে সরকার। বিকনাতে ডোকরা শিল্পের কমন প্রোডাকসন সেন্টার গড়া হচ্ছে। সেখানে ডোকরা শিল্প বানানোর পাশাপাশি বিপণনেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ডোকরা শিল্পকে আধুনীক করতেও বিভিন্ন চিন্তাভাবনা চলছে আমাদের। তরুণ শিল্পীদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।” তাঁর অভিমত, মেলার মাধ্যমে শিল্পীদের বাইরের জগতের লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হবে। এতে বাইরের বাজার ধরারও সুযোগ তৈরি হবে। এই মেলা শিল্পডাঙার প্রায় ৬০টি পরিবারকে নতুন কোনও দিশা দিতে পারে কি না সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy