জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যাওয়ার পরে মেয়েটি চাকরি পেয়েছিলেন চিৎপুর রেল ইয়ার্ডে। তার পর থেকে ইয়ার্ডের চার কর্মী রেল চত্বরেই তাঁকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে চলেছে বলে অভিযোগ। গর্ভবতী অবস্থাতেও বন্ধ হয়নি সে নির্যাতন।
দু’দিন আগে রেল পুলিশের দ্বারস্থ হলে চিৎপুর এবং দমদমের জিআরপি অভিযোগ তো নেয়ইনি। এমনকী মেয়েটির দ্বিতীয় স্বামীর দাবি, প্রায় রিজওয়ানুরের ঘটনার স্মৃতি উস্কে দিয়ে চিৎপুর জিআরপি-এর অফিসার তাঁকে বলেছিলেন, এ রকম এক মহিলাকে কেন বিয়ে করেছ? ওকে ছেড়ে দাও।
শুক্রবার বিকেলে বিষয়টি জানার পরে আনন্দবাজারের তরফে যোগাযোগ করা হয় শিয়ালদহের এসআরপি উৎপল নস্করের সঙ্গে। উৎপলবাবুর হস্তক্ষেপে দমদম জিআরপি-তে মহিলার অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। শুরু হয়েছে তদন্তের কাজও। উৎপলবাবু জানিয়েছেন, “ওঁদের মুখ থেকে সব শুনব। অভিযোগ প্রমাণ হলে ধর্ষকদের পাশাপাশি অবশ্যই দোষী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঘটনার সূত্রপাত চার বছর আগে। ২০১০ সালের ২৮ মে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় মারা যান ১৪৮ জন। সুন্দরবনের বাসিন্দা এই মেয়েটির স্বামীও তার মধ্যে ছিলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রেলমন্ত্রী। তিনিই মেয়েটিকে চিৎপুর রেল ইয়ার্ডের ‘এসএসইসি অ্যান্ড ডব্লুসিপি’ গ্যারাজে চতুর্থ শ্রেণির পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। ২০১১ সালের ২৪ অক্টোবর চিৎপুরে কাজে যোগ দেন মেয়েটি।
অভিযোগ, অল্প কিছু দিন পর থেকেই নির্যাতনের শুরু। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নামে চিৎপুর রেল ইয়ার্ডের এক প্রভাবশালী কর্মী ও তার কয়েক জন সঙ্গী কখনও ফাঁকা ট্রেনে, কখনও বা গ্যারাজের মধ্যে ওই মহিলাকে একাধিক বার ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। মোবাইলে সেই ছবিও তুলে রাখে অভিযুক্তেরা। মেয়েটির দাবি, মুখ খুললে মেরে ফেলবে বলে অভিযুক্তেরা তাঁকে শাসাত। ঘটনার কথা জানাজানি হলে মোবাইলের ওই ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দিত। এই জিৎ এবং তার দলবল দীর্ঘদিন ধরেই চিৎপুর এলাকায় নানা দুষ্কর্ম করে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারিণী।
এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে আঠাশ বছরের মেয়েটির দ্বিতীয় বার বিয়ে হয় এয়ারপোর্ট এলাকায়। নতুন স্বামীর জীবন বিমার এজেন্সি আছে। রং করার কাজও করেন।
অভিযোগ, বিয়ের পর থেকে জিৎ এবং তার সঙ্গীদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। মেয়েটি ভয়ে মাঝে মাঝেই কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিতেন। ওদের হাতে-পায়ে ধরে মিনতি করতেন, “আমার বিয়ে হয়েছে, নতুন সংসারও হয়েছে। এই নরক যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি দিন।” কিন্তু লাভ হয়নি। উল্টে স্বামীকে সব জানিয়ে সংসার ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মাস পাঁচেক আগেও তাঁকে ধর্ষণ করা হয়।
মেয়েটি এর মধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। আতঙ্কে বেশ কিছু দিন কাজে যাননি। ক’দিন আগে ফের রেলইয়ার্ডে গেলে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বাকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। মেয়েটি অভিযোগপত্রে লিখেছেন, ১৫ জুলাই জিৎ ও তার বন্ধুরা গ্যারাজের মধ্যে তাঁকে ধর্ষণ করে। “ওদের জানিয়েছিলাম, আমি অন্তঃসত্ত্বা। ওরা বলে, বাচ্চা মরে যাক। বরের নামে দোষ দিবি। না হলে আমরা তোকে মেরে ফেলব। বলব, কাজ করতে গিয়ে মারা গিয়েছে।’’ এ দিন হাতে-পায়ে ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে ওই মহিলা বলেন, “পেটের বাচ্চার কথা ভেবে আমি ওদের প্রাণপণে বাধা দিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আমায় মাটিতে ফেলে খুব মারছিল। চার জনের সঙ্গে একা লড়াই করে পারিনি।”
সে দিন বাড়ি গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন মেয়েটি। তাঁর স্বামী এ দিন আনন্দবাজারকে বলেন, “বাচ্চাটা আমার কি না, এই ধন্দে ওই রাতে বিষ খেয়েছিলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী-ই হাসপাতালে হাসপাতালে ছোটাছুটি করে আমাকে বাঁচিয়ে আনে। এর পর প্রতিজ্ঞা করি, দোষীদের শাস্তির জন্য অভিযোগ জানাতেই হবে।”
কিন্তু এ বার পুলিশের কাছে গিয়ে যে আর এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়তে হবে, সেটা তখনও জানা ছিল না ওই দম্পতির। এই বুধবার প্রথমে তাঁরা গিয়েছিলেন চিৎপুর জিআরপির আউটপোস্টে। “সব শুনেও অভিযোগ নেয়নি পুলিশ। এক বার আমাকে, এক বার আমার স্বামীকে আলাদা আলাদা ঘরে বসিয়ে অভিযোগ না করার জন্য চাপ দিতে থাকে।” মহিলার স্বামীর অভিযোগ, পুলিশ তাঁকে বলে, এ রকম এক মহিলাকে কেন বিয়ে করেছ? কেন নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছ? ওকে ছেড়ে দাও।
দাম্পত্য-সম্পর্কে পুলিশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ ঘিরেই সাত বছর আগে শিরোনামে এসেছিল রিজওয়ানুর রহমানের ঘটনা। যার জেরে পদ থেকে সরতে হয়েছিল কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার-সহ একাধিক কর্তাকে। রিজওয়ানুরের রহস্যজনক মৃত্যু, তাঁর ‘মেরে জানে কে বাদ আওয়াজ উঠানা’-র আর্তি নাগরিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের একাংশের মানসিকতা যে বদলায়নি, চিৎপুরের ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ বলে মনে করছেন অনেকেই।
পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণের ঘটনাতেও অভিযোগ নিতে গড়িমসি, ডাক্তারি পরীক্ষায় দেরি, ধর্ষিতার চরিত্রহননের মতো মারাত্মক অভিযোগ উঠেছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশের বড় কর্তার চাপে পুলিশ নিজেই ধর্ষকের সঙ্গে নাবালিকার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, এমনও অভিযোগও সাম্প্রতিক কালে এসেছে। অভিযোগ, সেই পরম্পরাতেই চিৎপুর জিআরপি এ বার নতুন নজির গড়ল। তারা ধর্ষণের অভিযোগ না নিয়ে স্বামীকে বলল, এমন স্ত্রীর সঙ্গে ঘর না করাই ভাল।
ওই দম্পতি যখন নাছোড়, তখন বুধবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ চিৎপুর তাঁদের পাঠিয়ে দেয় দমদম জিআরপি-র কাছে। অভিযোগকারিণীর বক্তব্য, তাঁদের বলা হয়, চিৎপুর আউটপোস্টটি দমদম জিআরপি-র অধীনে। অভিযোগ করতে হলে সেখানেই করতে হবে। “দমদম রেল পুলিশও সব শোনার পরে অভিযোগ না নিয়ে আমাদের ফিরিয়ে দেয়।” এ দিন দুপুর তিনটে নাগাদ ফের একই আর্জি নিয়ে দমদমে হাজির হন অসুস্থ মেয়েটি। অভিযোগ, দমদম জিআরপি তখন অভিযোগটি নেয়। কিন্তু নথিভুক্ত করে না। মেয়েটির দাবি, “আমরা ডায়েরির নম্বর চাইলে বলা হয়, সোমবারের পরে আসতে।” এর পরই বিষয়টি আনন্দবাজারের নজরে আসে।
শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় দমদমে যোগাযোগ করা হয়। দমদম জিআরপি-র পক্ষ থেকে বলা হয়, “এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। কোনও মহিলা এমন অভিযোগ করতে আসেননি।” এর পরেই আনন্দবাজারের তরফে যোগাযোগ করা হয় শিয়ালদহ রেল পুলিশ সুপার উৎপল নস্করের সঙ্গে। তিনি বলেন, “সাংঘাতিক ঘটনা! আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।” এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই উৎপলবাবু জানান, “সাড়ে তিনটে নাগাদ ওই দম্পতি দমদম জিআরপি-র কাছে গিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। মামলাও রুজু করা হয়েছে।” এ দিন রাতে ওই দম্পতিকে বসিয়ে তাঁদের বক্তব্য শুনেছে জিআরপি। আজ, শনিবার মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা হবে।
মূল অভিযুক্ত জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ ছিল। পরে তাকে এসএমএস-ও করা হয়। জবাব মেলেনি। পুলিশ জানায়, জিৎ ও অন্য অভিযুক্তরা ফেরার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy