সল্টলেকে জ্যোতি বসুর বাসভবনে অসীম দাশগুপ্তের সঙ্গে প্রণববাবু। তখন তিনি যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। ফাইল চিত্র
প্রণব মুখোপাধ্যায় দু’দফায় ভারতের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। দীর্ঘ দিন যোজনা কমিশনেরও ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে কাজের সঙ্গে তাঁর সেই ভূমিকারও আলোচনা হওয়া দরকার।
প্রণববাবু যখন প্রথমবার অর্থমন্ত্রী হন ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। পরের দফায় যখন তিনি ফের দেশের অর্থমন্ত্রী, তখন আমি রাজ্য সরকারে অর্থ ও পরিকল্পনা দফতরের দায়িত্বে। অর্থমন্ত্রী ও যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে প্রণববাবুর সঙ্গে আমার একাধিকবার আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ওঁর সঙ্গে কাজের গোটা স্মৃতিটাই খুব ইতিবাচক। রাজনৈতিক অর্থনীতিও উনি অত্যন্ত ভাল বুঝতেন। সবটাই পর্যালোচনা করতেন গভীর ভাবে।
ওঁর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভাবে মনে পড়ছে, কর কাঠামো সংস্কারের কথা। পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) কাঠামোর জন্য তখন রাজ্যগুলির অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে গড়া এমপাওয়ার্ড কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আমার সঙ্গে প্রায়ই কথা হত। ওই করের মূল কাঠামো রচনা হয় সে সময়। সেই সংক্রান্ত শ্বেতপত্র আমরা তুলে দিয়েছিলাম ওঁর হাতে। এ নিয়ে বহু বৈঠক হয়েছে। পণ্য-পরিষেবা করের প্রয়োগ নিয়ে ইদানীং অনেক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তবে শুরুর সময়টাতে এ নিয়ে আমাদের আলোচনা ইতিবাচকই হত। উনি ক্লান্তিহীন ভাবে শুনতেন আমাদের কথা। নর্থ ব্লকে ওঁর অফিসে তো বৈঠক হতই, এ ছাড়া একাধিকবার সন্ধ্যায় ওঁর বাড়িতেও আলোচনার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কখনও কখনও দীর্ঘক্ষণ সেই বৈঠক চলত।
তিন দফায় প্রণব মুখোপাধ্যায়
প্রথম দফা
• ইন্দিরা গাঁধীর জমানায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন ১৯৮২-৮৪ সাল।
• মনমোহন সিংহকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে আনেন তিনিই।
• জোর দেন সরকারি কোষাগারের হাল ফেরানোয়।
• বিশ্ব মঞ্চে সম্মানিত হন সেরা অর্থমন্ত্রী হিসেবে।
দ্বিতীয় দফা
• ১৯৯১-৯৬ সালে ছিলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান।
• তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের অর্থনীতির দরজা খোলার পদক্ষেপে অন্যতম কারিগরের ভূমিকা নেন।
তৃতীয় দফা
• ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় দফায় অর্থমন্ত্রীর পদে ফেরা ২০০৯ সালে। ছিলেন ২০১২ পর্যন্ত।
• তাঁর আমলেই উঠেছে কমোডিটি ট্রান্জাকশন ট্যাক্স।
• কাজ শুরু হয় জিএসটি-র কাঠামো তৈরির।
• সরকারের ঋণ কমিয়ে রাজকোষ ঘাটতিকে লক্ষ্যমাত্রায় বাঁধতে উদ্যোগী হন।
• ২০১০ সালের জুনে পেট্রলের দামে নিয়ন্ত্রণ ওঠে তাঁর সময়েই।
• বিদেশি সংস্থাগুলির সঙ্গে বকেয়া কর নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। বদলায় আয়কর আইন।
পণ্য পরিষেবা করের মূলত দু’টি ভাগ, কেন্দ্রীয় কর ও রাজ্যের কর। দু’ক্ষেত্রের মধ্যে সমন্বয় রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে আমাদের আলোচনা বেশ সদর্থক ছিল। আজ উনি চলে যাওয়ার পরে ক্ষতিটা উপলব্ধি করছি।
আরও পড়ুন: কীর্ণাহার থেকে রাইসিনা: চাণক্যের চড়াই-উৎরাই যাত্রাপথ
প্রতি বছর রাজ্যগুলির পরিকল্পনার আয়তন ও কেন্দ্র-রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে কথাবার্তা হত যোজনা কমিশনে। উনি যখন কমিশনে, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে সেই বৈঠকে গিয়েছি। সে যেন ছিল এক উজ্জ্বল সভা।
প্রণববাবু বরাবরই সব কথা অত্যন্ত ধৈর্য ধরে শুনতেন। বস্তুত, তিনি ছিলেন একজন ‘পেশেন্ট লিস্নার’। কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সকলের সঙ্গে কথা বলে একটা সহমতে পৌঁছনোর চেষ্টা করতেন।
তবে প্রণববাবু প্রথমবার অর্থমন্ত্রী থাকার সময়ে অষ্টম অর্থ কমিশন রাজ্যের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করেছিল, তার একটা ভাগ পশ্চিমবঙ্গ পায়নি। এ নিয়ে রাজ্য-কেন্দ্রের একটা মতপার্থক্য ছিল। যৌথ কাঠামোয় রাজ্যের উপর প্রচুর দায়িত্ব থাকলেও, অর্থ সংস্থানের জন্য মূল করের অধিকার ছিল কেন্দ্রেরই হাতে। কেন্দ্রের থেকে রাজ্যের ভাগ আদায় নিয়ে প্রণববাবুর সঙ্গে আমার কথাও সদর্থকই হয়েছে।
সব চেয়ে সুবিধা ছিল, ওঁর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা যেত। অনেক সময় একমত না-হলেও। বিশেষ করে কেন্দ্র-রাজ্যের সমস্যাগুলি নিয়ে আমাদের মধ্যে সে ভাবেই আলোচনা হয়েছে। কখনও কখনও সেই সব বৈঠক দু’ঘণ্টারও বেশি চলেছে।
নিজের সংসদ এলাকার বিষয়েও তিনি যথেষ্ট নজর রাখতেন। সে নিয়ে আলোচনা করতেন। বলা যেতে পারে, সব ক্ষেত্রেই একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতেন প্রণববাবু।
(লেখক রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy