মাসখানেক আগেও সত্যেন সিংহের (নাম পরিবর্তিত) জনধন অ্যাকাউন্টে ছিল ৩০০ টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজারে!
৮ নভেম্বরের আগে আম মাহাতোর (নাম পরিবর্তিত) জনধনে ১০০ টাকাও ছিল না। এখন রয়েছে ৩০ হাজারেরও বেশি!
অ্যাকাউন্ট ভারী হয়েছে সবিতা মাহাতোরও (নাম পরিবর্তিত)। গত তিন সপ্তাহে তিনি ৪০ হাজারেরও বেশি টাকা জমা দিয়েছেন যে!
কে এই সত্যেন সিংহ, আম মাহাতো, সবিতা মাহাতো?
মাওবাদী-সন্ত্রাস পর্বে পশ্চিম মেদিনীপুরের যে জায়গা দু’টির নাম বারবার উঠে এসেছে, এই তিন জনই সেই বাঁশপাহাড়ি-ভুলাভেদা এলাকার বাসিন্দা। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে জায়গাটা অন্তত ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে। গ্রামবাসীরা কেউ দিনমজুরি করেন। কেউ বাবুই ঘাসের দড়ি বানান। কারও পেশা চাষবাস। অধিকাংশেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।
তবে কী করে এই ক’দিনে এত টাকা জমালেন? কেউ সরাসরি, কেউ বা ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন ওই টাকা তাঁদের নয়। অন্যের। তাঁরা শুধু অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে দিয়েছেন।
কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যেই জনধন অ্যাকাউন্টকে হাতিয়ার করেছেন। দেশের গরিব মানুষের উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন, ‘‘আপনাদের জনধন অ্যাকাউন্টে যদি অন্য কেউ টাকা রেখে থাকেন, তা হলে সেই টাকা ফেরত দেবেন না। আপনারা যদি এই প্রতিশ্রুতি দেন, তা হলে যাঁরা বেআইনি ভাবে টাকা রেখেছেন, তাঁদের কী ভাবে জেলে পোরা যায়, সেটা আমি দেখছি।’’ কিন্তু সত্যেনবাবু, আমদেবী বা সবিতাদেবীরা এই আশ্বাসে ভরসা করতে পারছেন কি? সত্যেনবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘জমা রাখা ওদের টাকা ফেরত না দিলে কি আর রক্ষে থাকবে? ধনেপ্রাণে মারা যাব। তখন কি মোদী বাঁচাবেন?
বছর তিপ্পান্নর সত্যেনবাবু বাঁশপাহাড়ির বাসিন্দা। হাড়ভাঙা দিনমজুরি করে সংসার চালান। চাষজমি নেই। গরু-ছাগলও নেই। কয়েক বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে-বউমাকে নিয়ে সংসার। তাঁরাও দিনমজুরি করেন। সত্যেনবাবুর সম্বল বলতে টালির চালের এক চিলতে বাড়ি আর একটা ভাঙা সাইকেল।
কয়েক সপ্তাহে ৪৯ হাজার টাকা কোথায় পেলেন? উত্তর দিতে গিয়ে থতমত সত্যেনবাবু। ঢোক গিলে প্রথমে বললেন, ‘‘মেয়ের শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয় বাঁকুড়ায় থাকেন। তিনি টাকা রাখতে দিয়েছেন।’’ সেই আত্মীয় কে, কেনই বা টাকা রাখতে দিয়েছেন? এ বার অন্য উত্তর, ‘‘বাবু আমি গরিব মানুষ। এক রেশন ডিলার টাকা রাখতে দিয়েছেন। আমার কিছুই নেই।’’ কে সেই রেশন ডিলার? হাতজোড় করে সত্যেনবাবু বলেন, ‘‘আমাকে ছেড়ে দিন বাবু। করেকম্মে খেতে হবে তো!’’
আম মাহাতো এবং সবিতা মাহাতো ভুলাভেদার যে পাহাড়ি গ্রামের বাসিন্দা, সেখানে শ’দেড়েক পরিবারের বাস। বছর পঁয়তাল্লিশের আমদেবীকে দেখলে আরও বয়স্ক মনে হয়। খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়িতে থাকেন। কেন্দুপাতা কুড়িয়ে বিক্রি করেন। মাঝেমধ্যে খেতমজুরি। জনধন অ্যাকাউন্টে টাকা জমার কথা প্রথমে মানতেই চাননি। শেষে স্বীকার করেন, ‘‘মহাজন দিয়েছে।’’ সঙ্গে সংযোজন, ‘‘ওটা আমারই টাকা। মহাজনের কাছে ছিল।’’ সবিতাদেবীর বয়স ৫০ ছুঁয়েছে। বাবুই ঘাসের দড়ি পাকান। তাঁর দাবি, ‘‘গরু বিক্রি করে টাকা পেয়েছি।’’ কিন্তু গ্রামবাসীরা যে বলছেন, ওই টাকা মহাজনের কাছ থেকেই এসেছে? মুখ চুন করে দ্রুত ঘরে সেঁধিয়ে যান সবিতাদেবী।
শুধু এই তিন জনই নন, আশপাশের সব গ্রামেই চিত্র মোটামুটি এক। নোট বাতিলের ঘোষণার পর থেকে এই এক মাসে জনধন অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ার তালিকায় প্রায় প্রথম সারিতে উঠে এসেছে পশ্চিম মেদিনীপুর।বাঁশপাহাড়িতে পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। ভুলাভেদা থেকে বেলপাহাড়ি থানা অবশ্য কিছুটা দূরে। অন্তত ১০ কিলোমিটার।
প্রধানমন্ত্রীর কথামতো কালো টাকার কারবারিদের ‘জেলে পোরা’রকথা কেন ভাবছেন না গ্রামবাসীরা? কারণ জঙ্গলমহলের অর্থনীতির একটা বড় অংশই দাঁড়িয়ে রয়েছে মহাজনী ব্যবস্থায়। কেন্দুপাতা, শালপাতা বা বাবুই ঘাসের দড়ি সরকার ন্যায্য দামে কেনে ঠিকই, কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটা শেষ হতে সময় লাগে। সেই তুলনায় মহাজনেরা চটজলদি কাঁচা টাকায় ওই পাতা, দড়ি কেনেন। চাষের জন্য অনেক ক্ষেত্রে মহাজনেরা অগ্রিমও (দাদন) দেন। ফলে এ তল্লাটে গ্রামবাসীদের অনেকেই মহাজনের কাছে বাঁধা।
সেই মহাজনদের অনেকেই আবার রেশন ডিলারও। সরকারি প্রকল্পের চাল-গম পেতে তাঁদেরই দ্বারস্থ হতে হয় গরিব মানুষদের। তাই গ্রামবাসীদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘সারা বছর ওদের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকি। জলে থেকে কি কুমিরের সঙ্গে লড়ব? মারলে এরাই মারবেন। বাঁচালেও এরাই বাঁচাবেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy