পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোট মানে রক্ত ঝরবেই। প্রতীকী ছবি।
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোট মানে রক্ত ঝরবেই— গত কয়েক দশকে এটাই যেন ‘প্রথা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটি এলাকা বাম আমল থেকেই রক্তাক্ত হয়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে মানচিত্রে যোগ হয়েছে আরও নতুন উত্তেজনা-কেন্দ্র।
পূর্ব বর্ধমানে গলসি, জামালপুর-ই যেমন। গত কয়েক বছরে গলসির বিভিন্ন গ্রামে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের হিসাবে, অন্তত ২২টি জায়গায় বোমাবাজি হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে প্রচুর বোমা। গত বিধানসভা ভোটের পরে রাজনৈতিক হিংসায় জামালপুরে বিজেপি ও তৃণমূলের তিন জন খুন হন বলে অভিযোগ। সংঘর্ষে বেশ কয়েক জন আহতও হন।
দ্বন্দ্ব আছে তৃণমূলের অন্দরেও। তার জেরে জামালপুরের বেশ কিছু গ্রাম নানা সময়ে অশান্ত হয়েছে। এ বার পঞ্চায়েত ভোটে গোলমালের আশঙ্কা আছে বলে মনে করছে জেলা পুলিশের একাংশও।
উত্তর নদিয়ার করিমপুর ১ এবং ২ পঞ্চায়েতে আগে কখনও তেমন বড় গোলমাল হয়নি। তবে ইদানীং তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে কোন্দলের পরিবেশ ক্রমেই তপ্ত হচ্ছে। এই সব এলাকায় পঞ্চায়েত ভোটে অশান্তির আশঙ্কা করছেন অনেকেই। একই ভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে দক্ষিণ নদিয়ার পায়রাডাঙা, রামনগর-১, রঘুনাথপুর হিজুলি-২ পঞ্চায়েত এলাকা। রানাঘাট-১ ব্লকে তৃণমূলের দীর্ঘদিনের সভাপতি তাপস ঘোষকে সরিয়ে সেই পদে একদা তাঁরই ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শেফালি বিশ্বাসকে বসানো হয়েছে। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, দলের অন্দরে অনেকে এটা হজম করতে পারেননি। ফলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আশঙ্কা বাড়ছে।
হুগলির খানাকুল-২ ব্লকেও ছবিটা আলাদা নয়। আগের অনেক নেতাকে সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এখানে। ফলে ব্লকের ১১টি পঞ্চায়েত তো বটেই, আশপাশের আরও ২০টি পঞ্চায়েত এলাকা এর মধ্যেই
অশান্ত হয়ে উঠেছে। বিজেপি এবং সিপিএমও এখানে বেশ সক্রিয়। ফলে গোলমালের আশঙ্কা থাকছেই, মনে করছে পুলিশ-প্রশাসনেরই একাংশ।
পূর্ব মেদিনীপুরের সন্ত্রাস-মানচিত্রে নতুন নাম, ভগবানপুরের ভূপতিনগর এবং ময়নার বাকচা। ভূপতিনগরের অর্জুননগর এবং বরোজ এলাকায় গত বিধানসভা ভোটের পরে তৃণমূল কর্মীদের ঘরছাড়া করা হয় বলে অভিযোগ। জরিমানা আদায়েরও অভিযোগ উঠেছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। পাল্টা তৃণমূলের বিরুদ্ধে বোমা এবং অস্ত্র মজুত করার অভিযোগ রয়েছে। ৩ ডিসেম্বর ভূপতিনগরের নাড়ুয়াবিলা গ্রামে তৃণমূলের বুথ সভাপতির বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে। ফেব্রুয়ারিতে ইটাবেড়িয়ায় জঙ্গলে পরিত্যক্ত বোমা ফেটে জখম হন মা ও শিশু। স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ মাইতির অভিযোগ, ‘‘পুলিশ শাসক দলকে নিয়মিত মদত জুগিয়ে চলেছে।’’ তৃণমূলের পাল্টা দাবি, এলাকাকে অশান্ত করছে বিজেপি।
গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে লাগাতার উত্তপ্ত হয়েছে ময়নার বাকচা। এখানে বিজেপি শক্তিশালী। ২০২১ সালের ভোটে জয়ী হন বিজেপি প্রার্থী অশোক দিন্দা। দুই দলের টক্করে পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে এই এলাকায় নতুন করে গোলমাল বাধবে কি না, তাই নিয়ে আশঙ্কায় আছেন স্থানীয় মানুষ।
একই ভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরের মেদিনীপুর গ্রামীণ এবং খড়্গপুর গ্রামীণে নতুন করে অশান্তি শুরু হয়েছে। একে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল, তার উপরে বিজেপির প্রভাব বৃদ্ধিই অশান্তির মূলে। কয়েকটি এলাকায় নতুন করে শক্তি বাড়াচ্ছে সিপিএম। তাই উত্তাপ বাড়বে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা গত পঞ্চায়েত ও বিধানসভা ভোটের পর থেকে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়েছে। পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠন ঘিরে বিধায়ক রহিমা মণ্ডলের উপরে হামলা হয়। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে আইএসএফ সমর্থকদের উপরে হামলার অভিযোগ ওঠে। ২০২২ সালের জুন মাসে তৃণমূলের কার্যালয়ে হামলার অভিযোগ ওঠে সিপিএম-আইএসএফের বিরুদ্ধে। জখম হন তিন তৃণমূল নেতা। একই বছরের নভেম্বরে চাঁপাতলার গোঁসাইপুর বাজারে তৃণমূল কর্মী মিজান রেজা চৌধুরীকে কুপিয়ে খুন করা হয়।
সম্প্রতি দেগঙ্গায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও বার বার প্রকাশ্যে এসেছে। চাকলা পঞ্চায়েতে দমকলমন্ত্রী সুজিত বসুর সামনেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে এই বিধানসভারই কদম্বগাছিতে বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের বিরুদ্ধে তৃণমূল কর্মীরা পথে নেমে হুমকি দেন। সব মিলিয়ে উত্তেজনার পরিবেশ ক্রমশই দানা বাঁধছে এই এলাকায়।
সব দলের নেতাই এলাকা উত্তপ্ত হওয়ার পিছনে অন্যদের দায়ী করেন। দোষ ঠেলাঠেলির সে তরজা রাজ্যবাসীর কাছে পুরনো নয়। নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা এলাকাগুলিতেও তাই এখন প্রশ্ন— ঝামেলা এড়িয়ে নিজের ভোট নিজে দেওয়া যাবে তো এ বারে?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy