সিঙ্গুরের জমি নিয়ে ফের তরজা। ফাইল চিত্র।
ইতিহাস বলে, সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের ৪০০ একর জমি ফেরানোকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া জটিলতাই টাটাদের ন্যানো প্রকল্পকে সরে যেতে ‘বাধ্য করেছিল’ গুজরাতের সানন্দে। কিছুদিন আগে এর দায় তৎকালীন শাসকদল সিপিএমের ঘাড়ে চাপিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, জোর করে জমি দখল করতে গিয়ে টাটাদের তাড়িয়েছে সিপিএম-ই। কিন্তু সেই বয়ানের পরে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের পুরনো তথ্যের উপরে ভর করে বিরোধী শিবির এবং প্রবীণ আমলাদের একাংশের দাবি, আদতে ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের দিতে না চাওয়া জমির পরিমাণ ছিল ৪০০ একরের থেকে অনেক কম। তার উপরে, আন্দোলনের মুখে যে পরিমাণ জমি তৎকালীন বাম সরকার এবং টাটারা ছাড়তে রাজি ছিল, তা সরিয়ে রাখলে সমস্যা হত ‘মাত্র’ ৮৩ একর জমি নিয়ে। তাঁদের প্রশ্ন, তখন শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হলে, এত বড় প্রকল্পের জন্য ওইটুকু জমি নিয়ে ঐকমত্য়ে পৌঁছনো একেবারে অসম্ভব হত কি?
মন্ত্রী তথা তৎকালীন কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতা বেচারাম মান্নার অবশ্য দাবি, “ওই তথ্য ভুল। অনিচ্ছুক জমি-মালিক, বর্গাদার ও বর্গা চাষি মিলিয়ে জমির পরিমাণ ছিল ৪৫০ একর।” আবার তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য, “আসলে কত একর, তা প্রমাণ হবে কী করে? আলোচনাইতো হয়নি!”
কোন যুক্তিতে ৪০০ বনাম ৮৩ একরের তর্ক? সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের প্রায় ৪০০ একর ফেরতের দাবিতে অনড় ছিল তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল। অথচ নিগমের পুরনো তথ্যের ভিত্তিতে দেখানো হচ্ছে, সিঙ্গুরে টাটাদের কারখানার জন্য যে ৯৯৭.১১ একর অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৬৯১.৬৪ একরের ১০,৮৫২ জন জমিদাতাই (রায়ত) সরকারি ক্ষতিপূরণ নিয়েছিলেন। তা দেওয়া যায়নি ৩০৫.৪৭ একরের ২২৫১ জন রায়তকে। প্রবীণ ভূমিকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, যাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়নি, রাজনৈতিক ভাবে তাঁদের সকলকে তখন ‘অনিচ্ছুক’ বলে ধরে নেওয়ার দাবি উঠেছিল। কিন্তু যাঁরা ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করেননি, আদতে তাঁদের মধ্যে তিনটি ভাগ ছিল:— (১) মালিকানা যাচাইয়ের সময়ে কিছু জন ‘অ্যাওয়ার্ড ভেরিফিকেশনে’ অংশই নেননি। মূলত তাঁরাই জমি দিতে আগ্রহী ছিলেন না (২) কিছু জন অন্য দেশ বা রাজ্যে থাকায় প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেননি (৩) জমির মালিকানা নিয়ে কিচু পারিবারিক বিবাদ থাকায় তা মীমাংসার আগে ‘সিভিল কোর্টে’ ক্ষতিপূরণের অর্থ জমাও রেখেছিল তৎকালীন সরকার।
রাজ্য প্রশাসনের প্রাক্তন এক কর্তার কথায়, “এই সব পক্ষকে অনিচ্ছুক ধরে নিলেও জমি ৩০৫ একরের বেশি হয় না। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দলে থাকাদের জমি তা থেকে বাদ দিলে, দিতে না-চাওয়া জমির পরিমাণ আরও কম। ঘটনাচক্রে, সেই সময়ে কৃষিজমি রক্ষা কমিটির দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ছিল ২১৯.৭৪ একর।” ওই কর্তার দাবি, “সেই সময়ে বিরোধী প্রতিনিধিদের কাছে সরকারের প্রস্তাব ছিল, নিগমের হাতে থাকা ৪৭ একর এবং টাটাদের হাতে থাকা আরও প্রায় ৯০ একর মিলিয়ে মোট ১৩৭ একর জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সুতরাং, তা বাদে বাকি থাকে ৮২.৭৪ একর। প্রশ্ন উঠছে, ‘এইটুকু’ জমির কারণেই কি তবে ভেস্তে গেল কারখানা? পরে সে ভাবে কখনও চাষও হল না সেখানে! বেচারামের যদিও দাবি, “এখন ৯৬% জমিতে চাষ হচ্ছে।”
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, “সেই সময়ে এ সব তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই ছিল বামফ্রন্ট সরকারকে দুর্বল করা। ফলে তথ্যগুলিকে মানুষের কাছে পৌঁছনোর রাস্তা কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।” কিন্তু ফিরহাদের দাবি, “প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু জমির প্রকৃত পরিমাণ জানতে চেয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, টাটাদের রাজি করিয়ে এক দিক থেকে জমি ফেরত দেওয়া হোক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা মেনে নেন।... কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজি হননি। ফলে এ নিয়ে আর আলোচনা হয়নি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy