E-Paper

রোম্যান্সটাই ছাই হয়ে গেল, মুহ্যমান নেতা থেকে আমলা

আচমকা আগুনের গ্রাসে মঙ্গলবার রাতে ভষ্মীভূত হয়েছে হলংয়ের বনবাংলো। একটা পর্যটন আবাসকে ঘিরে এত স্মৃতিকাতরতা, এত ভাল লাগার অনুভূতি এ রাজ্যে সম্ভবত এই একটা জায়গাতেই জড়িয়ে ছিল।

Hollong Bungalow

ভষ্মীভূত হলংয়ের বনবাংলো। —ফাইল চিত্র।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৪ ০৭:২৩
Share
Save

কাঠের কঠামোটাকে একেবারে নাগপাশের মতো জাপ্টে ধরেছে আগুনের শিখা! ভিডিয়োটা পাঠানোর পরে রাজ্য প্রশাসনের প্রাক্তন এক বড় কর্তার প্রতিক্রিয়া এল, ‘‘অবিশ্বাস্য! একটা হেরিটেজ, একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল!’’

আচমকা আগুনের গ্রাসে মঙ্গলবার রাতে ভষ্মীভূত হয়েছে হলংয়ের বনবাংলো। একটা পর্যটন আবাসকে ঘিরে এত স্মৃতিকাতরতা, এত ভাল লাগার অনুভূতি এ রাজ্যে সম্ভবত এই একটা জায়গাতেই জড়িয়ে ছিল। অগ্নিকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়তে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলের প্রতিক্রিয়াই হলং বাংলোর স্মৃতির খাতা হয়ে উঠছে! কেউ বলছেন, প্রিয়জন হারানোর মতোই দুঃসংবাদ! আগে জানতেন না, আনন্দবাজারের কাছেই খবর পেয়ে কারও কারও গলায় আবার ঘোরতর অবিশ্বাস। নৈঃশব্দ্য আর প্রকৃতিকে এত কাছ থেকে ছুঁয়ে ফেলা যেত! বারান্দায় বসে থাকলে অদূরে ‘সল্ট পিট’কে ঘিরে গণ্ডার, হরিণ, কখনও হাতি। দৃশ্যগুলো পরপর ভাসছে ওঁদের চোখের সামনে।

মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসুর পুজোর ছুটিতে প্রিয় গন্তব্য ছিল হলং। বাংলোর বারান্দায় বসে গাছপালা এবং পশুপাখি দেখে কয়েকটা দিন কাটাতেন। ফিরে এসে কখনও সখনও মন্ত্রী বা সতীর্থ কাউকে ডেকে নিভৃতে কিছু পরামর্শ। তিন নাতনিকে নিয়েও হলংয়ের ওই বাংলোয় ছুটি কাটিয়েছেন জ্যোতিবাবু। মুখ্যমন্ত্রীর সেই হলং-শখ ঘিরে সে কালে বিতর্ক এবং চর্চাও হয়েছে অনেক। বাম জমানায় উত্তরবঙ্গের দুই মন্ত্রী যোগেশ বর্মণ এবং দীনেশ ডাকুয়া ছিলেন হলং-পর্বের সাক্ষী। অতীতে তাঁরা গল্প করতেন, মুখ্যমন্ত্রী যাবেন বলে সাধারণ পর্যটকদের বুকিং বাতিল করা নিয়ে কেমন বিড়ম্বনা হতো। হলং থেকে ফিরে জ্যোতিবাবু কখনও গাছ কাটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কখনও আবার বেশি হাতির পাল চোখে পড়ায় তা নিয়েও জানতে চেয়েছিলেন।

জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে ওই বাংলোয় মুখ্যমন্ত্রী বসুর সঙ্গে সময় না কাটালেও হলংয়ের জন্য বিশেয জায়গা এখনও রয়ে গিয়েছে প্রাক্তন আমলাদের কাছে। বাম আমলের স্বরাষ্ট্র ও মুখ্যসচিব এবং পরবর্তী কালে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক ও রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন মণীশ গুপ্ত। তাঁর মনে আছে, হলংয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমলারা যেতেন না। তবে আলাদা আলাদা ভাবে অনেকেই সেখানে থেকে এসেছেন। রাজ্যের আর এক প্রাক্তন মুখ্যসচিব অমিত কিরণ দেবের কথায়, ‘‘আমি আর সেই সময়ের অতিরিক্ত জেলাশাসক সুনীল মিত্র হলংয়ে থেকেছি। ওই বাংলো পুড়ে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতি। মনে পড়ছে, পাহাড়ে গোর্খ্যাল্যান্ড আন্দোলনের সময়ে বেশ কিছু পুরনো বাংলো পোড়ানো হয়েছিল। এগুলো পুনর্নির্মাণ করা হলেও আগের মতো আর হয় না।’’ কর্মক্ষেত্র বদলে অন্যত্র চলে যাওয়া প্রাক্তন আইএএস বা অবসরের পরে নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়া আইপিএস, এমন অনেকেই হলংয়ের খবরে শোকাহত। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘জ্যোতিবাবু কাউকে বিশেষ কিছু বলতেন না। তবে ওই দিকে বেড়াতে যাওয়ার আগে কখনও কখনও বলতেন, হলং বাংলো খালি আছে কি না খোঁজ নিতে! সরকারি ব্যক্তিত্ব এবং সাধারণ মানুষ, সকলের কাছেই বড় আকর্ষণের জায়গা ছিল ওই কাঠের বাংলো।’’ প্রাক্তন মুখ্যসচিব মলয় দে-ও সময় কাটিয়েছেন হলংয়ে। বাংলোর ছাই হয়ে যাওয়া তাঁর কাছেও অবিশ্বাস্য!

একই রকম শোকের ছায়া জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মহলেও। প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান বলছেন, ‘‘এ তো খুব কাছের কেউ মারা যাওয়ার মতো দুঃসংবাদ। জ্যোতিবাবু যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরেই পরে থেকেছি। বিলাসিতার কিছু নেই, জঙ্গলে থাকার জন্য কত দিনের পুরনো একটা বাংলো শুধু জায়গা হিসেবেই অতুলনীয়। ভাবতে পারছি না, হলং পুড়ে গিয়েছে!’’ তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায়ের মতে, ‘‘গোটা ডুয়ার্সে ওই রকম জায়গা আর নেই। বিধানসভার কমিটি সফরে গিয়ে থেকেছি। কাঠের এই বাংলো পুড়ে যাওয়ার পরে নতুন করে তৈরি করলেও পুরনো মেজাজ আর ফিরবে না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘রোম্যান্সটাই চলে গেল!’’

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের দাবি, ‘‘হৃদয়বিদারক ঘটনা। হলং বাংলো অগ্নিনির্বাপক কোনও ব্যবস্থা ছিল না? দমকলের দু’টি ইঞ্জিন কিছু করতে সমর্থ হয়নি। উত্তরবঙ্গের এ হেন ঐতিহ্য এ ভাবে ছাই হয়ে যেতে পারে না! কঠোর তদন্ত প্রয়োজন।’’ আর বর্তমানের বনমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা বলেছেন, ‘‘বাংলোর কর্মীরা আগুন দেখার সঙ্গে সঙ্গে খবর দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁচানো যায়নি।’’

স্রেফ একটা বাংলো নয়। অতুলনীয় এক পর্যটন-রোম্যান্সের মৃত্যুতে মুহ্যমান রাজ্য।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Hollong Bungalow Fire

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।