কুন্দন যাদব। —ফাইল চিত্র।
কুন্দন যাদবকে কে চিনত! অথচ গত কয়েক মাস সে ঘোরাফেরা করেছে এই রাজ্যেরই চৌহদ্দির মধ্যে। কখনও এসে থেকেছে কল্যাণীতে। কখনও ঘুরে গিয়েছে রানাঘাটের সোনার দোকানে।
তার পরে এক দিন আচমকা ডাকাতি।
রানাঘাটে সোনার দোকানে হানাদারিতেই কিন্তু শেষ নয় কুন্দনের খেল। তার সঙ্গেই যেন জড়িয়ে আছে গত কয়েক মাসের আরও কয়েকটি ঘটনা। কখনও ডাকাতি, কখনও খুন। বিভিন্ন জেলা থেকে তাই পুলিশ গিয়ে প্রথম কয়েক দিন হত্যে দিয়ে পড়েছিল রানাঘাটে। কুন্দনকে জেরা করতে চায় সকলেই।
এই ঘটনাগুলিকে যোগ দিতে শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের কাছে এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন: ১) কে এই কুন্দন? ২) তার সঙ্গে কোন কোন গ্যাং জড়িত এই ঘটনাগুলিতে?
তদন্তকারীরা শুরু করছেন সেই তপন কান্দু খুনের ঘটনা থেকে। তাঁদের কথায়, সেই সময় থেকে রাজ্যে আপাত শান্ত জেলাগুলিকে নিশানা করা শুরু হয়েছে। এমন সব জায়গায় দুষ্কৃতী উপদ্রব শুরু হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক ডামাডোল তুলনায় অনেক কম। এমন জায়গা, যা শান্তিপ্রিয় মানুষের বসবাসের এলাকা বা পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে। এমন জায়গা, যেখান থেকে দ্রুত পড়শি কোনও রাজ্যে গিয়ে গা ঢাকা দেওয়া যায়। দেড় বছর আগে তপন কান্দু খুনে তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, এই ঘটনার সঙ্গে বিহার-ঝাড়খণ্ডের যোগ আছে। এই ঘটনায় যারা ধরা পড়েছিল, তাদের মধ্যে দু’জন ওই দুই রাজ্য থেকে সুপারি কিলার হিসেবে এসেছিল।
কুন্দন নিজেও পড়শি রাজ্য থেকেই ‘অপারেট’ করে, দাবি তদন্তকারীদের। সম্প্রতি যে কাটিহার গ্যাংয়ের নাম সামনে উঠে আসছে, সেই দলের সঙ্গে তার যোগ কতটা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি খুন-ডাকাতির সঙ্গে কুন্দনের যোগ থাকতে পারে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের মতে, হয় কুন্দন নিজে সেই সব ঘটনায় ‘সুপারি’ নিয়েছিল, নয়তো তার গ্যাং কাজ করেছে। এবং প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন নিপুণ পরিকল্পনার ছাপ।
বর্ধমান বা শান্তিনিকেতন ঘুরতে যান যাঁরা, যাতায়াতের পথে তাঁরা একবার শক্তিগড়ের কোনও ল্যাংচার দোকানে দাঁড়াবেনই। ২ নম্বর জাতীয় সড়কের (যা দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে বলেও পরিচিত) দু’ধারে সার দিয়ে থাকা দোকানগুলি এলাকাটিকে কার্যত ‘ল্যাংচা হাব’ করে তুলেছে। এ বছরেরই ১ এপ্রিল। রাত তখন আটটা। কয়লা কারবারি রাজু ঝা আসছিলেন কলকাতার দিকে। সঙ্গে গরু ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ। গাড়ি কিছু ক্ষণের জন্য শক্তিগড়ে দাঁড়ায়। আচমকা একটু পিছনে এসে দাঁড়ায় আরও একটি গাড়ি। চকিতে নেমে এসে জনা তিনেক আততায়ী পরপর গুলি করে গাড়ির ভিতরে বসে থাকা রাজুকে। তার পরে কেউ কিছু বোঝার আগেই পালিয়ে যায়।
এই ঘটনার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ আধিকারিকেরা বলছেন, এর কিছু দিন আগে দুর্গাপুরে আক্রান্ত হয়েছিলেন রাজু। তিনি দুষ্কৃতীদের নিশানায় ছিলেন, বোঝাই যায়। কিন্তু তাঁকে খুন করার জন্য আততায়ীরা শেষ পর্যন্ত বেছে নিল তুলনায় শান্ত এলাকা শক্তিগড়। খুন করল বহু জোড়া চোখ এবং সিসি ক্যামেরার নজরের সামনে।
ওই পুলিশ আধিকারিকদের মতে, খুনটা যতটা দুঃসাহসিক, তার থেকেও অনেক বেশি পরিকল্পনার ছাপ ছিল পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে। আততায়ীরা এর পরে নিজেদের গাড়িতে করে শক্তিগড়ের ভিতরে ঢুকে পড়ে। সেখানে একটি আপাত নির্জন এবং সিসি ক্যামেরাহীন রাস্তায় সেই গাড়ি ফেলে, অন্য গাড়িতে চেপে পালায়। সন্দেহ করা হয়, ওই গাড়িতে চেপে তারা ভাতার, কাটোয়া হয়ে বীরভূমে ঢোকে, তার পরে সেই জেলা ধরে সোজা ঝাড়খণ্ডে পালিয়ে যায়।
সম্প্রতি পুলিশের জেরায় কুন্দন স্বীকার করেছে, রাজু ঝাকে সে-ই খুন করেছিল। অন্তত পুলিশের তেমনই দাবি। তাই কুন্দনকে পাকড়াও করার পরেই সেখানে হাজির হয় আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের একটি দল।
রানাঘাটেও কিন্তু দুঃসাহসিক কাণ্ডই ঘটিয়েছিল কুন্দনদের গ্যাং। একই দিনে একই সময়ে তারা রানাঘাট ও পুরুলিয়ায় একই সোনার দোকানের দু’টি পৃথক বিপণিতে হামলা চালায়। পরে কুন্দনের কাছ থেকে জানা যায়, সে রানাঘাটের দোকানটিতে একাধিক বার ক্রেতা সেজে এসেছে। কল্যাণীতে বাড়ি ভাড়া করে ছিল বলেও পুলিশের একটি সূত্রে দাবি। অর্থাৎ, সব রকম ভাবে ‘রেকি’ করেই সে কাজে নেমেছিল। ঠিক যে ভাবে রাজু ঝায়ের ক্ষেত্রেও ‘রেকি’ করেই কাজে হাত দিয়েছিল খুনিদের দলটি।
ঘটনা পরম্পরা এখানেই শেষ নয়। গত কয়েক মাসের মধ্যে রায়গঞ্জে একটি সোনার দোকানে বড় ডাকাতি হয়। এবং সেটাও দিনেদুপুরে। ঠিক একই ভাবে গত বুধবার উত্তর দিনাজপুরের পাঞ্জিপাড়ায় মোটরবাইকে চেপে এসে তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান মহম্মদ রাহিকে খুন করে যায় কয়েক জন দুষ্কৃতী। রায়গঞ্জের ডাকাতির ঘটনায় সেখানকার পুলিশ কুন্দনকে জেরা করতে চায়। পাঞ্জিপাড়ার ক্ষেত্রে পুলিশ মনে করছে, এর পিছনে কাটিহার গ্যাংয়ের হাত থাকতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে পুলিশ এবং গোয়েন্দা মহলে কয়েকটি প্রশ্ন প্রধান হয়ে উঠেছে। প্রথমত, পরের পর এই ঘটনাগুলি কারা ঘটাচ্ছে? কাটিহার গ্যাং? নাকি আরও কয়েকটি দুষ্কৃতীর দল? দ্বিতীয়ত, কে বা কারা এদের পরিচালনা করছে? কুন্দন যদি এক জন হয়, তা হলে অন্য মস্তিষ্ক কে? তৃতীয়ত, এদের অপরাধের ধরন দু’রকমের। ভাড়াটে খুনি হিসাবেও এরা কাজ করছে, আবার নিজেরা ডাকাতিও করছে। মোট কথা, যে দুষ্কর্ম করলে টাকা মিলবে, তা-ই করছে এরা। এদের পিছনে তাই রাজনৈতিক মদত থাকাও অসম্ভব নয়। সেই মদত কারা দিচ্ছে? সর্বোপরি, এরা তুলনায় শান্ত এলাকাগুলিকে বেছে নিচ্ছে কেন? অপরাধ করে পুলিশের নজর এড়িয়ে চট করে পালিয়ে যাওয়ার জন্য? নাকি এলাকাগুলি থেকে পড়শি রাজ্যে যাওয়া সহজ বলে?
গত ছ’মাসে বীরভূমের সিউড়ি, উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ, মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া থেকে আসানসোল— রাজ্যের নানা প্রান্তে পর পর এমন ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় পুলিশ ওই সব রাজ্য থেকে অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করে এনেছে। কিন্তু যে হারে সীমানা পেরিয়ে এসে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা অপরাধ ঘটাচ্ছে, সেই ঘনঘটা চিন্তায় রাখছে পুলিশকে।
তাই প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে আন্তঃরাজ্য সীমানায় পুলিশি নজরদারি নিয়েও। সেখানেও কি রয়েছে ফস্কা গেরো?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy