কলকাতার বুকে চিট ফাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হতে হল বৃদ্ধ শিক্ষককে। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
সারদা, রোজভ্যালি, এমপিএস থেকে শুরু করে চিট ফান্ড নিয়ে ক’দিন আগেও রাজ্য রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতি ছিল উত্তাল। কিন্তু তার পরও চিট ফান্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে ১১ মাস সময় লাগল অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপকের। তা-ও অভিযোগ দায়ের হল আদালতের নির্দেশে।
রাজ্যের কোনও প্রত্যন্ত প্রান্তের ঘটনা নয়। খাস কলকাতার বুকে চিট ফান্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হতে হল বৃদ্ধ শিক্ষককে। শেষ পর্যন্ত শিয়ালদহ আদালত তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পর ৫ জুলাই এফআইআর দায়ের করে বেনিয়াপুকুর থানার পুলিশ।
অভিযোগকারী প্রণব রায় বেনিয়াপুকুর থানা এলাকার লিন্টন স্ট্রিটের বাসিন্দা। ২০১১ সালে তখনও প্রকাশ্যে আসেনি সারদা, রোজভ্যালি সহ রাজ্যের এক গুচ্ছ চিটফান্ডের প্রতারণা। তখন প্রণববাবু বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনলজি বিভাগের অধ্যাপক।
তিনি শিয়ালদহ আদালতকে জানিয়েছেন, আওধকুমার সিংহ এবং মৈনাক চট্টোপাধ্যায় নামে দুই ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। আওধকুমার সিংহ নিজেকে আরিয়ান অ্যাগ্রো প্রোজেক্টস্ লিমিটেড নামক একটি সংস্থার ডিরেক্টর হিসাবে পরিচয় দেন। মৈনাক সেই সংস্থার একজন এজেন্ট হিসাবে পরিচয় দেন প্রণববাবুকে। অভিযোগ, আওধ এবং মৈনাক তাঁকে জানান, তাঁদের সারা দেশে প্রচুর কৃষি জমি রয়েছে। তাঁরা সেই জমিতে লগ্নি করেন। আওধ এবং মৈনাক দু’দফায় প্রণববাবুকে ২০১১ সালে এবং ২০১২ সালে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা লগ্নি করান ওই কোম্পানিতে। সেই লগ্নির সাপেক্ষে তাঁকে দু’টি ডিবেঞ্চার সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। জানানো হয়, ২০১৭ সালে ওই লগ্নির টাকা মোটা সুদের সঙ্গে ফেরত মিলবে। ওই সার্টিফিকেট অনুযায়ী, ৩১ মার্চ ২০১৭ সালে তাঁর ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা ফেরত পাওয়ার কথা ছিল।
আরও পড়ুন: বর্ধিত কন্টেনমেন্ট জ়োনে নতুন করে ঘরে বন্দি, কাল বিকেল ৫টা থেকে
প্রণববাবু আদালতকে জানিয়েছেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি টাকার খোঁজ করতে গেলে আওধকুমার সিংহ এবং মৈনাক চট্টোপাধ্যায়ের কোনও হদিশ করতে ব্যর্থ হন। ওই সংস্থার হাওড়ার সাঁকরাইল, শিবপুরের দানেশ শেখ লেন, বাঁশদ্রোণীর মেট্রো প্লাজা বিল্ডিং সহ বিহারের বক্সারের ঠিকানাতেও সমস্ত অফিস তালা বন্ধ পান। অভিযোগকারী খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ওই সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি)। বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার উপর নজরদারি করা কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সেবি-র সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গিয়েছে, প্রণববাবুর মতো আরও অনেক লগ্নিকারীকে একই ভাবে ডিবেঞ্চার দিয়ে প্রতারণা করেছে ওই সংস্থা। সেবি ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে ওই সংস্থা এবং তার ডিরেক্টরদের জানিয়ে দেয়, তারা বেআইনি ভাবে টাকা বাজার থেকে টাকা তুলেছে। অবিলম্বে সেই টাকা লগ্নিকারীদের ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন সেবি-র পূর্ণ সময়ের মেম্বার রাজীবকুমার আগরওয়াল। সেবি-র পক্ষ থেকে ওই সংস্থাকে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ বিশদে জানাতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পর থেকেই বেপাত্তা হয়ে যা্ন ওই সংস্থার ডিরেক্টররা। চিটফান্ড নিয়ে তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা বলেন, ‘‘ওই একই কায়দায় ডিবেঞ্চার দিয়ে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছিল রোজভ্যালি এবং এমপিএস।” সেবি-র প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, ডিবেঞ্চার বেচে বাজার থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা তুলেছিল আরিয়ান অ্যাগ্রো।
সেবি-র তদন্ত শুরু হওয়ার পরই প্রকাশ্যে আসে, ওই সংস্থায় যাঁদের ডিরেক্টর হিসাবে দেখানো হয়েছে, তাঁদের বেশ কয়েকজন জানতেনই না তাঁরা কোনও কোম্পানির ডিরেক্টর। ঠিক যেমন সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন বাড়ির পরিচারককে ডিরেক্টর বানিয়েছিলেন। ডিরেক্টরের তালিকায় থাকা শৈলেশকুমার মিশ্র সেবি-কে জানিয়েছেন যে, তাঁর সই জাল করা হয়েছে। তিনি কখনও ওই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সেবি-কে শৈলেশকুমার মিশ্র আরও জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি নেতাজি নগর থানা, বিভাগীয় ডেপুটি কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন)-কে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন। সেবি-র তদন্তে উঠে এসেছে, শৈলেশ গোটা বিষয়টি নিয়ে আলিপুর আদালতে মামলাও করেছিলেন আওধকুমার সিংহ এবং সংস্থার কয়েকজন ডিরেক্টরের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন: দু’-তিনটি দুর্নীতিকেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে, বললেন মমতা
প্রণববাবুর অভিযোগ, ওই চিটফান্ডের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও বাঁশদ্রোণী থানা এফআইআর করতে অস্বীকার করে। তিনি বাঁশদ্রোণী থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলেন ১৬ অগাস্ট ২০১৯ সালে। কিন্তু বার বার অনুরোধের পরও থানা অভিযোগ না নেওয়ায় শিয়ালদহ আদালতের শরণাপন্ন হন অবসরপ্রাপ্ত ওই শিক্ষক। শিয়ালদহ আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় বিচারক সমস্ত তথ্য-প্রমাণ দেখে বেনিয়াপুকুর থানাকে এফআইআর নথিভুক্ত করে তদন্ত শুরু করতে বলা হয়েছে।
বেনিয়াপুকুর থানা ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রতারণা এবং অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের জন্য নির্দিষ্ট ৪২০, ৪০৬, ৪০৯ এবং প্রাইজ চিট অ্যান্ড মানি সার্কুলেশন ব্যানিং আইনে মামলা করা হয়েছে।
কিন্তু চিটফান্ডে নিয়ে গোটা রাজ্য তোলপাড় হওয়ার পরও কেন পুলিশের গড়িমসি অভিযোগ নিতে? তা নিয়ে মুখ খোলেননি কলকাতা পুলিশের কেউ। প্রণববাবু যে সময়ে বাঁশদ্রোণীতে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন সেই সময়ে যিনি বিভাগীয় ডেপুটি কমিশনার ছিলেন, তিনি বদলি হয়ে গিয়েছেন। গোটা ঘটনা শুনে কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন,‘‘অনেক পুরনো ঘটনা। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, কেন সেই সময়ে এফআইআর করেনি থানা?” তবে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কারণ তাঁর দাবি, চিটফান্ডে সংক্রান্ত বিষয়ে থানগুলিকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। তবে বাস্তবে যে সেই নির্দেশ কার্যকর হয়নি তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী প্রণববাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy