ফাইল চিত্র।
সাধারণ গাড়িও রাতারাতি হয়ে যাবে ‘ভিআইপি কার’! এর জন্য খরচ মাত্র এক থেকে দেড় হাজার টাকা। ওতেই বসিয়ে দেওয়া যাবে নীল বাতি (ব্লু বেকন)। সঙ্গে আরও কিছু টাকা খসালেই জুটে যায় পুলিশ, সিবিআই, সিআইডি, ভিজিল্যান্স বা কেএমসি-র বড় পদের নাম লেখা স্টিকার। মালিকের ওজন বাড়াতে পাওয়া যায় গাড়ির সামনে বা পিছনে লাগানোর জন্য তিন-চারটে স্টার। দু’-এক দিন সময় দিলে তৈরি হয়ে যায় ভিআইপি গাড়ির মতো বনেটে লাগানোর পতাকাও!
ভুয়ো প্রতিষেধক-কাণ্ডে ধৃতের নীল বাতির গাড়ি নিয়ে শোরগোল পড়ার পরে শহর জুড়ে রমরমিয়ে চলতে থাকা এমন গাড়ি সাজানোর ব্যবসার দিকেই এখন নজর পুলিশের। শ্যামবাজার, মল্লিকবাজার, কসবার মতো বেশ কিছু জায়গায় এ জন্য হানাও দিয়েছেন তদন্তকারীরা। তপসিয়া, যাদবপুর, বেলেঘাটার চাউলপট্টি এলাকার কয়েকটি গ্যারাজ মালিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলেও পুলিশ সূত্রের খবর। যদিও তদন্তকারীদের একটি অংশ জানাচ্ছে, দীর্ঘদিন থেকেই ট্র্যাফিক বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গাড়ি সাজানোর রমরমা ব্যবসা চলছে শহরে। নিয়ম ভেঙে গাড়ির চার দিকের কাচে ‘ফিল্ম পেপার’ বসিয়ে ঘোলাটে করে দেওয়া হচ্ছে। চালকের দৃষ্টিপথ আটকে স্টিকার লাগানো হচ্ছে গাড়ির পিছনের বা সামনের কাচে।
যদিও মোটরযান আইনের ১৯২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, গাড়ির সামনের এবং পিছনের কাচের কোনও অংশ ঢেকে ফেলার কথা নয়। ওই দুই কাচ দিয়ে আলো চলাচল ৭০ শতাংশের কম করা যাবে না। গাড়ির জানলার কাচও অস্বচ্ছ করা বেআইনি। আইন অনুযায়ী, জানলার কাচ দিয়ে আলো চলাচল ৫০ শতাংশ রাখতেই হবে। আইন ভাঙলে পুলিশ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও মামলা করতে পারে। পরে একই অপরাধে ধরা পড়লে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
এমন ভাবে গাড়ি সাজানোর প্রক্রিয়া কী? সাধারণ গাড়ি নিয়ে এক দিন যাওয়া হয়েছিল মল্লিকবাজারে। এক দোকানদার বললেন, “একেবারে আসলের মতো দেখতে যন্ত্রাংশ এখানে পাবেন জলের দরে।” নীল বাতি পাওয়া যাবে কি না, জানতে চাওয়ায় ওই ব্যক্তি বলেন, “ভালর দাম হাজার টাকা পড়বে। কম দামেরও আছে। কিন্তু তাতে আওয়াজ, আলো কম। নিজেকে ভিআইপি ভাবায় কষ্ট হবে!” কয়েকটি দোকানে ঘুরে দেখা গেল, গোটা বাজারেই নীল বাতির দাম আটশো থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে।
পরের গন্তব্য, গরফার শহিদ নগরে। সেখানে রাস্তার দু’ধারে রয়েছে গাড়ি সাজানোর দোকান। স্টিকারের খোঁজ নিতে জানা গেল, পুলিশ থেকে সিবিআই, সিআইডি থেকে ভিজিল্যান্স অফিসার— সব ধরনেরই স্টিকার মিলবে তিনশো থেকে চারশো টাকা খরচ করলে। এক দোকানদার আবার গাড়িতে লাগানোর জন্য তিনটে স্টার বসানো প্লেট বার করে দেখিয়ে বললেন, “পিছনে বা সামনে লাগিয়ে নিন। পুরো ভিআইপি হয়ে যাবে গাড়িটা। দু’দিন সময় দিলে বনেটে লাগানোর পতাকাও বানিয়ে দেওয়া যাবে।”
সব চেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, কোথা থেকে এসেছি বা এ ভাবে গাড়ি সাজানোর বৈধ কাগজপত্র সঙ্গে আছে কি না, দু’জায়গার এক জন ব্যবসায়ীও তার কোনওটাই জানতে চাইলেন না। শ্যামবাজারের গাড়িপট্টিতে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা। সেখানে আবার নীল বাতির দাম চলছে পাঁচশো থেকে দু’হাজার টাকার মধ্যে। এ ভাবে যার-তার গাড়িতে নীল বাতি লাগিয়ে, ভিআইপি সাজিয়ে দেওয়া যায়? শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী সুখেন গুপ্ত বললেন, “পুলিশ তো আমাদের কাগজপত্র দেখতে বলেনি। তা ছাড়া নীল বাতি তো অ্যাম্বুল্যান্সেও লাগানো হয়।” কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়া কোন কোন গাড়িতে ওই বাতি লাগানো যেতে পারে, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তো অর্ডিন্যান্স জারি করেছে!
এদের ধরতে কী করে কলকাতা পুলিশ? কলকাতা পুলিশের কোনও কর্তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি। ট্র্যাফিক পুলিশের ডিসি অরিজিৎ সিংহকে বার বার ফোন করা হলেও ধরেননি। মেসেজেরও উত্তর দেননি। তবে ভুয়ো প্রতিষেধক-কাণ্ডে তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের এক আধিকারিক বলেন, “এমন গাড়ি নিয়ে কোর্টে প্রশ্ন উঠেছে। সব থানা এবং ট্র্যাফিক গার্ডকে এমন গাড়ি নিয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। খোলা বাজারে নীল বাতি বিক্রি আটকাতে কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy