Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Narendra Modi

মোদীর মুখে মনোমোহন বসুর বাংলা কবিতা, কে এই কবি

রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে ছেড়ে তুলনামূলক ভাবে ‘অখ্যাত’ মনোমোহন বসুর কবিতা কেন বেছে নিলেন প্রধানমন্ত্রী, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।

গোটা দেশের সামনে বাঙালি কবির কবিতা পাঠ নরেন্দ্র মোদীর।

গোটা দেশের সামনে বাঙালি কবির কবিতা পাঠ নরেন্দ্র মোদীর।

পম্পা অধিকারী সিংহ
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২০ ১৮:১১
Share: Save:

আম জনতাকে ‘স্বদেশি’-র মাহাত্ম্য স্মরণ করাতে গিয়ে বাঙালি কবির দ্বারস্থ হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী!

তবে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল নন, এ ক্ষেত্রে কবি হিসেবে তুলনামূলক ভাবে ‘অখ্যাত’ মনোমোহন বসুকেই বেছে নিলেন তিনি। পরাধীন ভারতে বিদেশি দ্রব্য বর্জনের ডাক দিয়ে যে কবিতা লিখেছিলেন মনোমোহন, তার দু’ছত্র রবিবার দেশবাসীর সামনে পাঠ করে শোনান প্রধানমন্ত্রী। হিন্দিতে তার তর্জমা করে নিজের দেশে তৈরি পণ্য কেনার জন্য সাধারণ মানুষকে আর্জি জানান। অতঃপর প্রশ্ন উঠছে, কেন মোদী বাঙালি কবির ওই কবিতাই বেছে নিলেন?

বস্তুত, ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই কবিতা-চয়ন বর্তমানে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, বিধানসভা নির্বাচনের আগে শুধুমাত্র বাঙালি ভাবাবেগ কুক্ষিগত করতেই কি মনোমোহনকে টেনে আনলেন মোদী, নাকি হিন্দু মেলার ঘোর সমর্থক মনোমোহনের কবিতা পাঠ করে বঙ্গের হিন্দুদের মনজয়ের চেষ্টা করলেন? বঙ্গে হিন্দুত্বের পালে হাওয়া টানতে বার বার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে দৃষ্টান্ত তুলে আনে বিজেপি। রবিবার ঋষি অরবিন্দের কথাও উঠে আসে মোদীর মুখে। তার পরই শোনা যায় মনোমোহনের ওই কবিতার অংশ।

আরও পড়ুন: বঙ্গভোটের ‘মন কি বাত’! মোদীর মুখে অরবিন্দ ঘোষ থেকে বাংলা কবিতা​

কবি সুবোধ সরকার বলেন, ‘‘পরাধীনতার যন্ত্রণা নিয়ে গোটা জীবন কাটিয়েছেন মনোমোহন। পরাধীন ভারতে সূচ, সুতো, দেশলাই পর্যন্ত লন্ডন থেকে আসত। বন্দরে জাহাজ এসে ভিড়ত। সেখান থেকে বাজারে যেত। কবির লেখা এই কাব্যে জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগ ফুটে উঠেছে। তাই হতে পারে নিজের স্বনির্ভর ভারত গড়ে তোলার পরিকল্পনাকে তার সঙ্গে জুড়তে চেয়েছেন মোদী। তবে পরাধীন ভারত এবং মোদী-ঘোষিত ডিজিটাল ভারত, দুই যুগে‌ এই জাতীয়তাবাদের প্রাসঙ্গিকতা সম্পূর্ণ আলাদা। পরাধীন ভারতে মনোমোহনের জাতীয়তাবাদ এবং যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বনির্ভর ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন প্রধানমন্ত্রী, তার মধ্যে ফারাক রয়েছে।’’ মনোমোহনের ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে এখনকার বিভাজনের রাজনীতির কোনও সংযোগ নেই বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।

প্রসঙ্গত, রবিবার প্রধানমন্ত্রী মনোমোহনের যে কবিতাটি উদ্ধৃত করেছেন, তা ১৯৫৯ সালে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরুণকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংকলিত এবং সম্পাদিত ‘উনবিংশ শতকের গীতিকবিতা সংকলন’-এ প্রকাশিত ‘দিনের দিন্ সবে দীন’ কবিতার অংশ। বিদেশি দ্রব্য বর্জনের সপক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে "ছুঁই সূতো পর্যন্ত আসে তুঙ্গ হ’তে, দীয়াশলাই কাটি, তাও আসে পোতে/ প্রদীপটি জ্বালিতে, খেতে, শুতে, যেতে, কিছুতেই লোক নয় স্বাধীন!" ছত্রগুলি লেখেন তিনি।

বাংলায় সেই ছত্রগুলি পাঠ করার পাশাপাশি রবিবার সেটির হিন্দি তর্জমাও করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘‘অর্থাৎ, সুচ-সুতো থেকে দেশলাই কাঠি সবই আসত বিদেশ থেকে। খাওয়া, জল পান করা, এমনকি ঘুমনোতেও স্বাধীনতা ছিল না। আমরা স্বদেশি বলতে বোঝাতে চাইছি, ভারতে তৈরি, ভারতীয়দের তৈরি জিনিস ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।’’

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গ নজরে গেরুয়া শিবিরের। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, বাংলার মানুষের কথা মাথায় রেখেই হয়তো অরবিন্দের কথা বলার পর বাঙালি কবিকে বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

আরও পড়ুন: মহিষাদলে নীল-সাদা মঞ্চেই শুভেন্দু, চুপ রইলেন দলীয় প্রসঙ্গে​

কে এই মনোমোহন?

১৮৩১ সালে অভিন্ন ২৪ পরগনার ছোট জাগুলিয়ায় জন্ম মনোমোহনের। ১৯০৫ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন তিনি। সুদীর্ঘ আট দশকের জীবনে কবি, সাংবাদিক, নাট্যকার, মঞ্চাধ্যক্ষ, গীতিকার-সহ নানা ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। ছাত্রজীবনে স্কটিশ সমাজকর্মী ডেভিড হেয়ারের সংস্পর্শে আসেন তিনি। হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল-সহ কলকাতায় একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন হেয়ার। তাঁকেই শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন মনোমোহন। তার বাইরেও দু’জনের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। কবি ঈশ্বর গুপ্তেরও শিষ্য ছিলেন। অক্ষয়কুমারের দত্তের ঘনিষ্ঠ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।

ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রেরণাতেই মনোমোহনের সাহিত্যচর্চা শুরু। ছাত্রাবস্থায় ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ এবং অক্ষয়কুমারের ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হত। পরবর্তী কালে নিজে ‘বিভাকর’ এবং ‘মধ্যস্থ’ নামের দু’টি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বও সামলেছেন। এর পর ধীরে ধীরে যাত্রা এবং নাটকের দিকে ঝোঁকেন তিনি।

আরও পড়ুন: ভয়ে আমার নাম বলে না বিজেপি, ভাইপো বলে ডাকে, তোপ অভিষেকের

তৎকালীন বাংলায় রুচিশীল, মৌলিক নাটক তেমন দেখা যেত না। যে কারণে উচ্চবিত্ত-অভিজাতরা নাটকে সে ভাবে উৎসাহ দেখাতেন না। ‘রামাভিষেক’, ‘সতী’, ‘হরিশচন্দ্র’-এর মতো একাধিক পৌরাণিক নাটক রচনা করে সেই অভাব ঘোচানোর চেষ্টা করেন মনোমোহন, যা যাত্রা-পাঁচালি-কথকতার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা নাটকের ইতিহাসে আদি, মধ্য এবং আধুনিক যুগের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে। ‘রামাভিষেক’-এ নিজে অভিনয়ও করেন।

পরাধীন ভারতেই গোটা জীবন কাটিয়েছেন মনোমোহন। ঔপনিবেশিক শাসনে পীড়িত এবং করভারে জর্জরিত ভারতীয়দের দুঃখ, দুর্দশার কথা তাই ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর নাটকগুলিতে। ফুটে উঠেছে জাতীয়বাদের ভাবাবেগ। হিন্দুধর্মের আচার-বিচার নিয়ে ‘হিন্দুর আচার-ব্যবহার’ নাটকটিও রচনা করেন মনমোহন। হিন্দু মেলাকে গভীর ভাবে সমর্থন করতেন তিনি। ‘মনোমোহন গীতাবলী’ নামে তাঁর গানের একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়।

এমনই এক ‘অখ্যাত’ কবির কবিতার লাইন রবিবার স্থান পেল প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’-এ। মোদীর এই বক্তৃতা যিনি তৈরি করেছেন, তাঁর তারিফ করতেই হয়!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy