অন্নপূর্ণার শীর্ষে পিয়ালি বসাক।
পয়লা বৈশাখ মানেই তো অধিকাংশ বাঙালির কাছে দোকানে-দোকানে হালখাতা, মিষ্টির প্যাকেট, আনকোরা জামার গন্ধ আর জমিয়ে খাওয়াদাওয়া। কিন্তু আপাদমস্তক বাঙালি বাড়ির মেয়ে হয়েও আমার কাছে এ বারের নববর্ষ ছিল এক্কেবারে অন্য রকম। পিঠে রাকস্যাক নিয়ে সে দিন একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম অন্নপূর্ণা (৮০৯১ মিটার) সামিটের দিকে। কিন্তু কে জানত, বাধা হয়ে দাঁড়াবে পরিকল্পনায় ছোট ভুল আর দড়ি-বিভ্রান্তি! না হলে নববর্ষের সকালেই অন্নপূর্ণার শীর্ষে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম। তা-ও আবার অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাহায্য ছাড়া।
প্রাণবায়ুর ওই সিলিন্ডার পিঠে না নিয়ে যে কোনও আটহাজারি শৃঙ্গের চূড়ায় পৌঁছনো তৃপ্তির, আনন্দের, গর্বেরও। অন্নপূর্ণার চূড়া ছুঁয়ে তাই অসম্ভব ভাল লেগেছে স্বাভাবিক ভাবেই। তবু কোথাও বুকের মধ্যে হয়তো রয়ে গেল একটা চিনচিনে ‘অতৃপ্তি’— ইস্, যদি নববর্ষের দিনেই সামিট করা যেত।
১৪ এপ্রিল, ক্যাম্প-৩ (৬৩০০ মিটারে) থেকেই সোজা অন্নপূর্ণার সামিটের উদ্দেশে রওনা দেব বলে ঠিক করেছিলাম। ভেবেছিলাম, ফিক্সড রোপ লাগানোর প্রথম শেরপা দল ও পর্বতারোহী নির্মল পূরজার দলের সঙ্গেই এগিয়ে যাব। কিন্তু বাদ সাধলেন আমার দলের বাকি আরোহীরা। ফলে বেরোতে দেরি হয়ে গেল। দেখি, পূরজাদের দল দু’ঘণ্টা আগে বেরিয়ে
গিয়েছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া, সারা রাত চলে সে বার প্রায় ৮০২০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছেও যাই। কিন্তু এক জায়গায় দেখি, কিছুটা এলাকা জুড়ে ফিক্সড রোপ লাগানো নেই। তাতেই আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। কোন পথে এগোতে হবে, কী ভাবে যাব, সেটা বুঝতে অনেকটা সময় চলে যায়। অকারণ ঝুঁকি নিতে চাইনি। নববর্ষের দিন সামিট অধরা রেখেই নেমে আসি ক্যাম্প ৪-এ।
নেমে এসে দেখি, আয়োজক সংস্থা মাত্র একটি তাঁবু পাঠিয়েছে। এ দিকে আরোহী ও শেরপা মিলিয়ে দলে রয়েছি ৯ জন! ফলে তাঁবুতে আমাদের বসার জায়গাটুকুও নেই। সন্ধ্যার সেই কনকনে ঠান্ডায় তাঁবুর বাইরেই ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম দু’জনে। পরে অন্য একটি দল সামিট-পুশে বেরোলে তাঁদের তাঁবুতে ঢুকি। পরের দিন সকালে দেখি, কানে-গলায় ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব। বেশ চিন্তা শুরু হয়ে গেল, এমন শরীর খারাপ নিয়ে অক্সিজেন ছাড়া যাব কী করে!
কিন্তু বিশ্রামের উপায় নেই, সামিট করার সময় শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। তাই একটি মাত্র সিলিন্ডারের ভরসায় কিছুটা দেরিতেই, বিকেল ৩টে নাগাদ আবার সামিট-পুশ শুরু। আট হাজার মিটার পেরিয়ে যাওয়ার পরে শেরপা স্যরের পরামর্শমতো অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবহার শুরু করি। ১৭ তারিখ সামিটে পৌঁছই সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে (স্থানীয় সময়)। প্রবল হাওয়ার মধ্যে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। এমনকি হাতে পতাকাও ঠিক করে ধরে রাখা দায়।
অন্নপূর্ণায় গিয়ে বিপদে পড়া দুই ভারতীয় আরোহীর সঙ্গেই সামিটের পথে দেখা হয়েছিল আমার। ক্যাম্প-৪ থেকে কিছুটা এগিয়েই রাজস্থানের অনুরাগ মালুর সঙ্গে দেখা হয়। জানিয়েছিলেন, সামিট না করেই নেমে যাচ্ছেন। তার পরেই ঘটেছিল সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা।
আর হিমাচলের বলজিৎ কউর তো ছিল আমার আয়োজক সংস্থার দলেই। ১৬ এপ্রিল সকাল ১১টা নাগাদ দুই শেরপাকে সঙ্গে নিয়ে ও সামিট-পুশে বেরিয়ে যায়। তবে কখন যে ওকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছি, নিজেও জানি না। সামিট থেকে নামার পথে, ১৭ তারিখ বেলা ১২টা নাগাদ যখন দেখা হয় বলজিতের সঙ্গে, তখনও ও সামিটের দিকে চলেছে! আমার শেরপা তখনই ওর অবস্থা দেখে কিছুটা শঙ্কিত হয়েছিলেন। আমরা তো ভালয়-ভালয় ক্যাম্প ৪-এ নেমে ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়ি। এ দিকে রাত ২টো নাগাদ বলজিতের দুই শেরপা নেমে এসে খবর দিল, বলজিৎকে চেষ্টা করেও নামাতে পারেনি, তাই নিজেদের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে ওকে উপরেই রেখে এসেছে!
আসলে নামার পথে এত বিপজ্জনক সব জায়গা রয়েছে যে, কেউ নিজে পা না ফেলতে পারলে, শেরপাদের পক্ষে তাঁকে নামানো প্রায় অসম্ভব। রাতেই বেসক্যাম্পে খবর পাঠানো হয়। শুরু হয় উদ্ধারের তোড়জোড়। পরদিন বলজিৎ আর অনুরাগকে নিয়ে যখন আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আমরা নেমে আসি বেসক্যাম্পে। এর পরে খবর পাই, বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পড়িমড়ি করে তাই আজ, রবিবার বাড়ি ফিরেছি। আগামী ২৭ তারিখ আবার রওনা দেব কাঠমান্ডু। এ বার লক্ষ্য মাকালু(৮৪৮১ মিটার)!
(অনুলিখন: স্বাতী মল্লিক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy