পিঙ্কি বর্মণ খুব খুশি বিজেপি তাঁকে প্রার্থী করায়। — নিজস্ব চিত্র।
পিঙ্কি বর্মণ। কোচবিহার জেলা পরিষদের ন’নম্বর আসনে প্রার্থী। শুধু ওই আসনেই নয়, কোচবিহার জেলা পরিষদের সব আসন মিলিয়ে পিঙ্কিই একমাত্র তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে তাঁর নামের পাশে ‘অন্যান্য’ (আদার্স) বলে লিঙ্গ পরিচয়ের উল্লেখ।
পিঙ্কি অবশ্য দীর্ঘ দিনের রাজনীতিক নন। এ সমাজে সাধারণ ভাবে একজন বৃহন্নলা যে ভাবে জীবনযাপন করেন, তেমনটাই করেন তিনি। তবে তার পাশাপাশি বরাবরই সমাজের জন্য কিছু করার কথা ভেবেছেন। করছেনও। তার পরে বুঝেছেন, খুব বড় আকারে কিছু করতে হলে রাজনৈতিক পরিচয় কাজে দেয়। তাই রাজনীতিতে এসেছেন। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে প্রার্থী হওয়ার সুযোগও পেয়ে গিয়েছেন। পিঙ্কির কথাবার্তায় তাই শুধু বিজেপির জয়গান। নিজের দল বলে যতটা, তার চেয়ে বেশি তাঁকে দলে নেওয়ার জন্য। আনন্দবাজার অনলাইনকে পিঙ্কি বলেন, ‘‘আর কোনও দলের বৃহন্নলা প্রার্থী রয়েছে কি না জানি না। খালি জানি বিজেপি, বিশ্বের সবচেয়ে বড় দল আমায় প্রার্থী করেছে। তাই আমি খুব গর্বিত। খুব খুশি।’’
দিন রাত এক করে প্রচার করছেন পিঙ্কি। শুধু নিজের জন্য স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থীদের জন্যও গলা ফাটাচ্ছেন। বাড়ি তাঁর মাথাভাঙায়। কোচবিহার শহর থেকে খুব দূরে নয়। কিলোমিটার দশেক দূরেই অশোকবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিঙ্কি জন্মের পরে পরেই মাকে হারান। বছর দশকে বয়স হতেই বুঝতে পারেন তিনি আর পাঁচটা মেয়ের মতো নন। শারীরিক গঠন বুঝিয়ে দিত থাকে ভিন্ন লিঙ্গপরিচয়।
লেখাপড়া কত দূর করেছেন? প্রশ্ন শুনে পিঙ্কি বলেন, ‘‘সুযোগই পাইনি। আমি যা জানি, যা শিখেছি সবটাই জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে। আমার পরিচয় জানার পরে সমাজও আমায় ভাল চোখে দেখেনি। অনেক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে।’’ একটু থেমে ফের বললেন, ‘‘তবে সমাজ যাই করুক আমি তার বদলা নিতে চাইনি। আমি বরং, সমাজের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। করেও চলেছি।’’ কী কী করেছেন পিঙ্কি? স্থানীয় বিজেপি নেতারা বলছেন, এমনি এমনি প্রার্থী করা হয়নি। ওঁর সমাজসেবামূলক কাজের জন্য মাথাভাঙার মানুষ এক ডাকে চেনে পিঙ্কিদেবীকে।
বাড়ি বাড়ি সন্তান হলে ‘ছেলে না মেয়ে’ খোঁজ নিতে যাওয়াই তো প্রধান কাজ পিঙ্কির। সেই সূত্রেই আয়। তবে এর সঙ্গে ‘মনসার গান’-এর গায়িকা হিসাবে ওই এলাকায় সুনাম রয়েছে তাঁর। কোচবিহারে স্থানীয় ভাষায় যেটাকে ‘বিষহরা’ গান বলা হয়। স্থানীয় বিজেপি কর্মী বিজয় বর্মণ বলেন, ‘‘আমাদের এখানে বিষহরা গানের জন্য পিঙ্কি বর্মণের নাম রয়েছে। গানের সঙ্গে উনি খুব ভাল নাচেন।’’ আয়ের টাকা অবশ্য শুধু নিজের জন্য খরচ করেন না পিঙ্কি। প্রথমে অনাথ বৃহন্নলাদের জন্য একটি আশ্রম তৈরি করেন। নাম দেন, ‘জীবন গাড়ি ফেরিওয়ালা’। বৈরাগীর হাট এলাকায় ওই আশ্রমের মধ্যেই এখন আবার একটা আলাদা অংশ জুড়েছেন। সেখানে সাধার বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের জন্য একটি আশ্রম বানিয়েছেন পিঙ্কি। পিঙ্কির নিজের কথায় ‘‘মা-বাবাদের জন্য আশ্রম।’’ পাশেই তৈরি করছেন বিষ্ণু মন্দির। পিঙ্কি বলেন, ‘‘এ গুলো করতে আমার খুব ভাল লাগে। মনসার গান বা কীর্তন, বৃহন্নলার কাজ সব করি। কারণ, ভাল কাজ করতে গেলে টাকা লাগে। এর পরে মানুষের দোরে দোরে ভিক্ষাবৃত্তি করে টাকা জোগাড় করি আশ্রমের জন্য, মন্দির বানানোর জন্য।’’ বাবা হন্যানারায়ণ বর্মণ ছিলেন কৃষক। দরিদ্র পরিবারের সন্তান পিঙ্কি মাকে হারানোর পরে দাদি, দিদিদের কাছেই মানুষ হন। তার পরে বৃহন্নলার জীবন নিয়ে কিছুটা ভবঘুরে হয়ে যান। এখন তিনি থিতু হয়েছেন নিজের গ্রামে। এ বার রাজনীতিতে যোগ এবং ভোটপ্রার্থী। পিঙ্কি বলেন, ‘‘এখানে বিজেপি খুব ভাল ফল করবে। লোকসভা আমাদের, বিধানসভাতেও ভাল ফল হয়েছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও মানুষ আমাদেরই বেছে নেবে। আমিও জিতব।’’
জিতলে কী করবেন? একটুও না ভেবে পিঙ্কির জবাব, ‘‘অনেক কাজ করব। আমি শুধু বৃহন্নলাদের জন্য নয়, সমাজের সব মানুষের জন্য, নারী, পুরুষ সবার জন্য কাজ করতে চাই।’’ কী কাজ? পিঙ্কি বললেন, ‘‘সমাজের সবচেয়ে বড় অভিশাপ দারিদ্র। আমার ছোট সামর্থ্যের মধ্যে চেষ্টা করব মানুষ যাতে খাবার, বাসস্থান পায়। পরনের কাপড় পান।’’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘‘আমি লেখাপড়া করতে পারিনি। এখন মনে হয় লেখাপড়া জানলে আরও ভাল হত। আমি তাই চাইব, সবাই যেন লেখাপড়া করতে পারে।’’ একটি স্কুল খোলারও পরিকল্পনা রয়েছে, জানালেন পিঙ্কি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy