ঝাড়গ্রামে কদমকাননের শবরপাড়ায় নথি খুঁজছেন বাঁটুল মল্লিক। পাশে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা লালু মল্লিক। নিজস্ব চিত্র
পুজোর জাঁকজমকের চেয়ে শত আলোকবর্ষ দূরে দাঁত বার করা ইটের গাঁথনির একচিলতে বাড়ির দাওয়ায় বসে আতিপাতি করে ভাঙা তোরঙ্গ হাতড়াচ্ছিলেন লালু মল্লিক।
ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড রয়েছে। কিন্তু জমির দলিলটাই যে মিলছে না। লালুকে সাহায্যে এগিয়ে এলেন তাঁর ছেলে বাঁটুল। তাঁর চেষ্টাও ব্যর্থ হল। চিন্তিত মুখে বাঁটুল বললেন, ‘‘এই জমিতে পূর্বপুরুষের বাস ছিল। কিন্তু জমির নথি তো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। জন্মের শংসাপত্রও নেই আমাদের। এনআরসি-র জন্য নাকি কী সব লাগছে! কীভাবে প্রমাণ করব জানি না।’’ বাঁটুলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বছর আটান্নের লালু বললেন, ‘‘কী দিনকাল পড়ল, এ দেশে জন্মেও প্রমাণ দিতে হবে আমরা এ দেশের লোক।’’
ঝাড়গ্রাম শহরের কদমকাননের শবর পাড়া। লালু, বাঁটুলের মতো আরও অনেকেরই বাস এখানে। ঝাড়গ্রাম জেলার আদিম জনজাতি অধ্যুষিত লোধা-শবর পল্লি গুলিতেও শুরু হয়েছে এনআরসি আতঙ্ক! দরিদ্র লোধারা বংশপরম্পরায় বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। ঝাড়গ্রাম শহরের লোধা-শবর পল্লির বাসিন্দারা অবশ্য দিনমজুরি করেন। কেউ আবার রেলের কুলির কাজ করেন। লালু ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। বাঁটুল দিনমজুরি করে সংসার চালান। বাবা-ছেলে এখন হন্যে হয়ে খুঁজছেন জমির দলিল। অরণ্যশহরের কদমকানন শবর পাড়ার বছর সাতান্নর চামটু ভুক্তার অবশ্য জমির কাগজ ছিল। কিন্তু চিন্তা পিছু ছাড়ছে না তাঁকেও। চামটুর কথায়, ‘‘বাপ ঠাকুর্দার আমলে জমির একটা কাগজ ছিল। সেটা উই কেটে দিয়েছে। ওই জমি আমার নামেও নেই।’’
ঝাড়গ্রাম ব্লকের মানিকপাড়া পঞ্চায়েতের বারবিঘা গ্রামের শবর পাড়ায় অধিকাংশ বাসিন্দার জন্মের শংসাপত্র নেই। অনেকের আবার আধার কার্ড নেই। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও নেই। ঝুপড়ি ঘরে বাস করেন রঞ্জিত মল্লিক ও মালতি মল্লিক। ভোটার কার্ড হারিয়ে গিয়েছে তাঁদের। দম্পতির কথায়, ‘‘দেশ থেকে কিছু লোকজনকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে বলে শুনেছি। আমাদের তো কোনও নথিই নেই। তা হলে কী হবে আমাদের!’’ ঝাড়গ্রাম শহরের চাঁদাবিলা শবর পাড়ার লতিকা শবর জানালেন, খাস জমিতে মাটির বাড়ি করে আছেন। আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড হয়েছে। কিন্তু জমির নথি নেই। চাঁদাবিলার প্রবীণ মেথরা মল্লিক বলেন, ‘‘বেশির ভাগ লোধা-শবর খাস জমিতে বসবাস করেন। জমির নথি কোথায় পাবেন। আবার যাঁরা পাট্টা পেয়েছেন, সেগুলির বেশির ভাগই ১৯৭১ সালের পরে। সচেতনতার অভাবে শিশুর জন্মের পরে আর জন্মের শংসাপত্র সংগ্রহ কিংবা সংরক্ষণ করা লোধা-শবরদের ধাতে নেই। ফলে সমস্যার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।’’
এনআরসি নিয়ে চলছে রাজনৈতিক বিতর্ক। এ রাজ্যে এনআরসি হবে কি না, তা নিশ্চিত নয় এখনও। হলেও কী কী নথি গ্রাহ্য হবে তা জানা নেই। কিন্তু আতঙ্ক গ্রাস করেছে শবরপাড়াগুলিতে। মানিকপাড়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান মহাশিস মাহাতো বলেন, ‘‘আদিম অরণ্যচারী লোধা-শবরদের পাশাপাশি, জনজাতি শ্রেণির বেশির ভাগ অংশের কাছে এখনও আধার কার্ড পৌঁছে দেওয়া হয়নি। রাজ্যের ভোটার কার্ড আর রেশন কার্ডই অধিকাংশ লোধা-শবরদের সম্বল। তাও দিনযাপনের রুজির লড়াইয়ে সেগুলিও তাঁরা হারিয়ে ফেলেন।’’
মেদিনীপুর লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাই নায়েক জানান, পুজো মিটেছে। এ বার সংগঠনের তরফে এনআরসি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy