Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

স্যার বলেন, তোরাই অসুরদলনী

মানবাজার, বান্দোয়ানের পুজোর মেলা ঠিক আছে! কিন্তু এই পাহাড়ে চড়ার মজাটাই আলাদা। শারদ সকালে তাই রোজিনা, পল্লবীদের হাত ধরে টান দেয় ডুমুরু। ‘‘ওরে আয় রে, উপর থেকে সবুজ খেত না-দেখলে নাই বুঝবি, কী মিস করছিস তোরা!’’

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:০০
Share: Save:

মানবাজার, বান্দোয়ানের পুজোর মেলা ঠিক আছে! কিন্তু এই পাহাড়ে চড়ার মজাটাই আলাদা।

শারদ সকালে তাই রোজিনা, পল্লবীদের হাত ধরে টান দেয় ডুমুরু। ‘‘ওরে আয় রে, উপর থেকে সবুজ খেত না-দেখলে নাই বুঝবি, কী মিস করছিস তোরা!’’ চিরুগোড়া গাঁয়ের কিনারে মাহাতো পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখা যায়, শবরপাড়া বা শুশুনিয়া কলেজের বাড়ি। কংসাবতী-কুমারী বাঁধের টলটলে জল। কিন্তু ত্রিসীমানায় মেলার মাঠ বা পুজোর মণ্ডপের চিহ্ন নেই। সচরাচর মনের চোখেই তাই দেখা হয় মা দুর্গার সঙ্গে।

বিকেল পাঁচটার পরে বাস মেলে না! পুজো দেখতে হলে, মামা কিংবা বাবার বাইক। অথবা গ্রামের ক’জন মিলে ভাড়া করা ম্যাজিক গাড়ি। চিরুগোড়া, পুঁড়দহা, তামাখুন, বসন্তপুর গ্রামে পুজো কই? উৎসবের সন্ধেয় আনাচে-কানাচে বরফের মতো অন্ধকার! পুঁড়দহার দিকে কুটনির তেঁতুলতলা পার হয়ে যেতে ভয়ে পা সরে না। গাড়িসুদ্ধ আস্ত মানুষ নাকি ভূতে গায়েব করে দেয়!

ঘন আঁধারেই তবু রোখ চাপে পলকা বুকের খাঁচায়। স্কুলে সংস্কৃতের মাস্টার বশির মল্লিক স্যারের কথাটা ঘন ঘন মনে পড়ে! তিনি শিখিয়েছেন, তোরাই অসুরদলনী দুর্গা! অসুর এখানে একটা নয়। কম সে কম তিনখানা। কম বয়সে বিহা-ঘর করা, কম বয়সে স্কুল ছেড়ে কামকাজে যোগ দেওয়া আর ভূতপ্রেত কি ডাইন অপবাদের কুসংস্কার! এই তিন শত্তুরের সঙ্গে লড়াই করাই ওদের পণ। স্কুলের ফুটবল টিমের ব্যাক মৌসুমি হাঁসদা ‘অপয়া’ বুড়িদের খবর আনে। মুখ দেখলে নজর লাগে বলে গ্রামে একঘরে তাঁরা! আগে ওরাও ভয় পেত এ সব শুনলে। এখন বুঝছে, যত্ত সব অন্ধ বিশ্বাস।

কিলোমিটার চারেক দূরে বসন্তপুরের আদিবাসী স্কুল। সেখানে কন্যাশ্রী ক্লাবের মুখ ওরাই। পুরুলিয়া টাউনের কলা উৎসবে ‘মুক্তির পাখি কন্যাশ্রী’ নাটকে দারুণ পার্ট করেছিল ডুমুরু। ভাল নাম সব্যসাচী। তোর বাবা ব্যাটাছেলের নাম কেন রাখলেন? টরটরিয়ে ঝগড়া করে ডাকাবুকো ক্লাস টেন। কেন মেয়েদের কি দু’হাত সমান চলে না? মেয়েরাই তো দশভুজা হয়।

ক্লাস নাইনের রোজিনা ক্লাবের সহ-সভাপতি। তার সতীর্থ টিংটিঙে পল্লবী ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী’। ব্লক মেডিক্যাল অফিসারের কাছে শিখে-পড়ে রোগবালাইয়ের বিষয়ে সবার চোখ খোলাই তার কাজ। আর ক্লাস এইট-এর শুচিস্মিতা কোষাধ্যক্ষ। বাল্যবিবাহ রোধ থেকে পথ-নিরাপত্তা অভিযানের ফেস্টুন— দু’পাঁচ টাকা চাঁদা তুলে নিজেরাই খরচ জোগাড় করে মেয়েরা। সে টাকা কোথায় যত্নে গুছিয়ে রাখে, শুচি কিছুতেই কাউকে বলবে না।

সাদা সালোয়ার-কামিজ, কমলা ওড়নার এই কিশোরী-বাহিনীকে ইদানীং খানিক মান্যি করেন মাতব্বরেরা। হেলমেটবিহীন বাইক সওয়ারি সমঝে চলেন। এই বুঝি রসগোল্লা খাইয়ে গাঁধীগিরি করবে কন্যাশ্রী-র মেয়েরা!

ক্লাস নাইনের নিবেদিতা মাহাতো গম্ভীর মুখে বারো ক্লাসের অঞ্জলিদিদিকে মনে করায়, চিরুগোড়ার দুই বোনের কথা। কাজলি আর বিজলির বাবা পরের জমিতে বাগাল খাটেন। বছর দুই ধরে স্কুলে আসাই বন্ধ ছিল দু’বোনের। মাস তিনেক আগে এক দুপুরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এই মেয়েরাই তো মিছিল করে গিয়েছিল কাজলিদের বাড়ি। মেয়ে দু’টো তখন বাপের পায়ে-পায়ে পরের জমিতে খাটতে গিয়েছে। মা জ্যোৎস্না সিং স্বীকার করলেন, আগুইবিল গ্রাম থেকে কুটুমের চেনা পাত্র দেখে গিয়েছে মেয়েকে। অঞ্জলিদের মনে পড়ে স্কুলের মল্লিকাদিদি, প্রতিমাদিদিদের কথা। পড়াশোনা জলাঞ্জলি দিয়ে তারা এখন কোলে ছানা নিয়ে সংসারী! রুখে দাঁড়ায় ধানি লঙ্কার দল। ক্লাস এইটে ফের স্কুলে ফেরে কাজলি-বিজলি।

মহালয়ার আগের দিন জরুরি কনফারেন্স। মেয়েরা নিজেরাই মাথা খাটায়, দুই বোনে হাতে বইখাতা নিয়ে তিন কিলোমিটার হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে আসে! বইয়ের ব্যাগ কিনে দিলে তো হাসি ফোটে! সাত-তাড়াতাড়ি চাঁদা তুলে আর স্যারেদের কাছে একটু হাত পেতে মুশকিল আসান। ক্লাব সভাপতি অঞ্জলি মাহাতো মানবাজার থেকে কাজলিদের জন্য নতুন ব্যাগ কিনে আনে। ছুটির আগে শেষবেলায় সবার হাসিতেই পুজোর রোদ্দুর।

তবু লড়াইয়ের শেষ নেই। বড়রা তর্ক করেন, ‘‘আঠেরোর পরে বর কুথায় মিলবেক? তরা সব বেশি বুঝে গেছিস!’’ সনকা হাঁসদা, স্মৃতি মাহাতোরা কটকট করে বলে, ‘‘হঁ, ঠিকই বুঝেছি। তুমরা আগে মাইয়া না-দিলে পাত্রপক্ষ বাধ্য হবে সেই মাইয়াটাকে বিহা করতে!’’ নিজের
বাড়িতে কেউ বিয়ের কথা বললেও সটান হুমকি, ১০৯৮ নম্বরে হেল্পলাইনে ফোন করে বলে দেব।

বছর সাতেক আগে পুরুলিয়ার বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুনদের সাহসকে কুর্নিশ করেছিল গোটা দেশ। অকালে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা রুখে দিয়েছিল তারা। আজকের ‘কন্যাশ্রী’ স্কুলপড়ুয়াদের জন্য সরকারি সাহায্য আসে! তবে আসল পুঁজি আত্মবিশ্বাস। মেয়েদের ক্লাব কয়েক মাসেই বদলে দিয়েছে মুখচোরাদের। সামনে আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে, জানেন বসন্তপুরের হেডস্যার অজয় মাহাতো।

ওরাও সেটা জানে! ছুটির হাওয়াতেও পা টেনে ধরে মেয়েবেলার নিষেধ আর সন্দেহের বেড়া। কুথায় যাচ্ছিস? কার সঙ্গে কথা বলছিস? এই ড্রেসে কেন বাইরে যাচ্ছিস? ‘‘এ সব শুনলে খুব খারাপ লাগে,’’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে মানভূম কন্যেরা।

জঙ্গলমহলের টিলার থেকেও ঢের উঁচু পাহাড় এখনও চোখ রাঙায়। আর হাজার বছরের অসুরের সঙ্গে যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত হয় বুকে বুকে।

অন্য বিষয়গুলি:

durga puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy