প্রণব মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
পাথর বিছোনো রাস্তা ধরে সাদা বাড়িটার দিকে হেঁটে যাচ্ছেন ছোটখাটো মানুষটা। শালুক ফুলে ঢেকে থাকা বাঁধানো চৌবাচ্চার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন আচমকা, তার পর নিজের মনেই যেন বিড়বিড় করলেন, ‘‘কী ঘন রং ধরেছে, দেখেছ!’’
আকাশ-ভাঙা রোদ্দুরে দিনভর নির্বাচনী প্রচারের পরেও জঙ্গিপুরের সেই সাদা নিরালা বাড়িতে ফিরে শালুকের ঝাঁক, আমের বোল কিংবা সন্ধের বারান্দায়, হাজারো কাজের ফাঁকে পাখির ডাকে কান পেতে থাকা একেবারে অচেনা এক প্রণব মুখোপাধ্যায়কে খুব কাছ থেকে দেখা রজত দাস অস্ফূট স্বরে শুধু বলতে পারলেন, ‘‘এটা ঠিক হল না!’’
যে জঙ্গিপুর তাঁকে প্রথম বার লোকসভায় পাঠিয়েছিল, মুর্শিদাবাদের সেই প্রান্তিক এলাকায় একটা দোহারা বাগানবাড়ি করেছিলেন প্রণববাবু। স্থানীয় কংগ্রেস নেতা রজতবাবু এখন সেই বাড়ি আগলে পড়ে রয়েছেন। প্রতিদিন সে বাড়ি সাফসুতরো, আগাছা সাফ করার তদারকি সেরে চিঠিপত্র দেখতে বসেন। ফোন করে দিল্লিতে তার খুঁটিনাটি জানাতেন এত দিন। তার পর অপেক্ষা করতেন, একটা ফোনের। রজতবাবু বলছেন, ‘‘শুনেছিলাম স্নানঘরে পড়ে গিয়েছেন। হাতে আর মাথায় চোট পেয়েছেন। তার
পরে নিজেই জানালেন কোভিড হয়েছে। এত লড়াইয়ের পরে এমনটা হবে ভাবিনি!’’ জামার হাতায় চোখ মোছেন তিনি। তার পর শেষ বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘সত্যিই আকাশে রং ধরেছে, মানুষটা যেন তা দেখতেই চলে গেলেন!’’
২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে যাঁকে হারিয়ে জঙ্গিপুরে জয়ী হয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, সিপিএমের সেই প্রাক্তন সাংসদ আবুল হাসনাত খানের গলাতেও স্পষ্ট হাহাকার। বলছেন, ‘‘নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মোড়া জীবন, তার পরেও করোনা হল? কিছুতেই মানতে পারছি না। আমার এখনও মনে আছে, সে বার জয়ী হয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘‘দেখলে তো হাসনাত, হারিয়ে দিলাম তোমায়!’’ সাগরদিঘির অবসরপ্রাপ্ত বামমনস্ক শিক্ষক জাটু মার্ডির গলাতেও সেই আক্ষেপ, ‘‘বামপন্থী ঘাঁটিতে ফাটল ধরিয়ে জঙ্গিপুরে ঠিক নিজের একটা পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছিলেন প্রণববাবু। সাগরদিঘির বহু আকাঙ্ক্ষিত কলেজ গড়ে দিয়েছিলেন।’’ সেই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন জঙ্গিপুরের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সিদ্ধেশ্বর পাহাড়িকে। তিনি বলছেন, ‘‘অবসর নিয়েছি, কিন্তু কলেজভবনের পাশ দিয়ে গেলেই সেই দিনটার কথা মনে পড়ে। তখন তিনি অর্থমন্ত্রী। সব ব্যস্ততা ঠেলে কলেজে এসে মিনিট পঁয়তাল্লিশের একটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাস নিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল।’’
অজস্র কথা মনে পড়ছে তাঁরও। তিনি মুক্তিপ্রসাদ ধর। জঙ্গিপুরে এসে তাঁর বাড়িতে প্রথম উঠেছিলেন প্রণববাবু। নিজের বাড়ি করার আগে অন্তত চার-চারটে বছর জঙ্গিপুরে সেটাই ছিল তাঁর ঠিকানা। এখন তৃণমূলে যোগ দেওয়া মুক্তি বলছেন, ‘‘ওই ঘরটায় আর
পা রাখতে পারি না। মনে হয় এখুনি যেন ডাকবেন, ‘‘মুক্তি এক বার শোন!’’
জঙ্গিপুর যেন চুপ করে সেই ডাকের অপেক্ষা করে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy