আফজর আলি মল্লিক, রাখহরি দত্ত এবং হাবিব মল্লিক। নিজস্ব চিত্র
মহাভারতের কথা অমৃতসমান— বললেন শেখ কামারুদ্দিন। তার পরেই তাঁর সংযোজন, ‘ফলে মেলা এই বছর করা গেল না, পরের বছর হবে। তাতে অসুবিধা নেই।’ শেখ কামারুদ্দিন, মহম্মদ হাবিব, আফজর আলি মল্লিকের মতো গ্রামবাসীরাই এখানে কাশীরাম দাস স্মরণোৎসব কমিটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। কমিটি গত ২৫ বছর ধরে কাশীরাম দাসের নামে গ্রামে মেলার আয়োজন করে, করোনার কারণে এ বার জানুয়ারি মাসে সেই উৎসব করা যায়নি।
মেলা সরাসরি কোনও অনুদান পায় না। সরকার কবিগান, ঢাকঢোল, মাদল ও লোকশিল্পীদের নিখরচায় পাঠায়। ১৯৬২ সালে বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে মেলাটা শুরু। তখন ছোট করে বৈশাখ মাসে হত। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কামারুদ্দিন বললেন, ‘‘বৈশাখে ঝড়জল, ধান রোয়ার কাজে সবাই ব্যস্ত থাকে। ফলে পরে দিনক্ষণ বদলে জানুয়ারির শীতে।’’ মেলার বাইরে অন্য বিষয় নিয়েও চেষ্টাচরিত্র করছেন গ্রামবাসীরা। পূর্ব বর্ধমান জেলার এই সিঙ্গি গ্রামে যদি কাশীরাম দাসের ধ্বংসপ্রাপ্ত ভিটেবাড়িটি সংরক্ষণ করে একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায়, সে বিষয়ে ২০১৫ সালে হেরিটেজ কমিশনে চিঠিও লিখেছেন ওঁরা। ঐতিহ্যের বাংলায় এখনও উত্তর আসেনি। কামারুদ্দিন নিয়ে গেলেন ধসে যাওযা এক ইটের বাড়িতে। সেখানে কাশীরাম দাসের জন্মভিটা। সাদা দেওয়ালে নীল হরফে কাশীদাসী মহাভারত থেকে আত্মপরিচয়, কায়স্থ কুলেতে জন্ম বাস সিঙ্গি গ্রামে। প্রিয়ঙ্কর দাসপুত্র সুধাকর নাম। ভিতরে ইটের দাঁতমুখ বার করা এক খন্ডহর। ‘‘এখানে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও এসেছিলেন। কাশীরাম তাঁর ভণিতায় ভিটেবাড়ির চৌহদ্দির যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, সবই মিলিয়ে দেখেছিলেন তিনি। ১৯২২ সালের সেটলমেন্ট রেকর্ডেও সেগুলি রাখা ছিল,’’ বললেন কামারুদ্দিন। কাশীরাম দাসের মহাভারত তিনি পড়েছেন।
পূর্ব বর্ধমানের এই ছোট্ট সিঙ্গি গ্রামে এখনও কাশীরাম দাসই প্রধান ‘ব্র্যান্ড ইকুইটি’। তাঁর নামেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাঠাগার, অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের স্কুল। পাঠাগার প্রায় বন্ধ, মেয়েদের স্কুলে এক জন শিক্ষিকা আছেন। আইনি জটিলতায় ও সরকারি নিয়োগের অভাবে বহু দিন কোনও শিক্ষিকা নেই, পড়াশোনার জন্য মেয়েদের কয়েক কিলোমিটার দূরে কোকরশাহ, মালডাঙা স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। কাশীরাম দাসের গ্রামে মেয়েদের সবুজসাথী প্রকল্পের সাইকেল আছে, স্কুল নেই।
স্বাস্থ্যও তথৈবচ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাজানোগোছানো বড় বাড়ি আছে। গ্রামের লোকেরা বললেন, তাঁরা ছেলেবেলায় দেখেছেন, সেখানে একদা প্রসব ও বিভিন্ন বিষয়ে ডাক্তার থাকতেন। এখন এক জন ফার্মাসিস্ট থাকেন, জ্বরজ্বারিতে তিনি সামলে দেন। বড় কিছু হলে কাটোয়ায় বড় হাসপাতাল। পাশের শ্রীবাটী, গৌর়ডাঙা অঞ্চলেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাল সে রকম। আশাকর্মীরাই ভরসা। ভ্যানরিকশয় চড়ে, মাইকে ঘোষণা করতে করতে ‘দুয়ারে সরকার’ এসেছে, সকলে স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডও করিয়েছেন। তবু কামারুদ্দিন থেকে ক্ষুদিরাম দত্ত— সব গ্রামবাসীর আফসোস, হাসপাতালটা যদি ঠিক করা যেত! কোনও স্পেশালিস্ট নয়, পাঁচ-সাতটি বেড ও এক-দু’জন পাশ করা ডাক্তার। সকলেই সমস্বরে জানালেন এই আকাঙ্ক্ষা।
সবুজ কৃষিপ্রধান গ্রাম। এখানে বর্ষা ও শীতে দু’বার ধান বোনা হয়। অনেকে বিভিন্ন ডাল, পিঁয়াজ, রসুন, ধনে বুনেছেন। জাল দিয়ে ঘেরা, বড় বড় নারকেলি কুলের কুলবাগিচা। গত বুধবার সাপ্তাহিক হাটে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, পাঁচ টাকায় বাঁধাকপি। আদা ও কাঁচা লঙ্কা পাঁচ টাকায় একশো গ্রাম। কথা বলে জানলাম, গ্রামের ১২ কিমি দূরে জগদানন্দপুরে কৃষি মান্ডি। অনেক সময় মান্ডি অবধি যেতে হয় না, ফড়েরা মাঠ থেকেই ধান ও সব্জি কিনে নেয়। হাটে দাঁড়িয়ে গল্পে গল্পে তাই কৃষি আইনের কথাও উঠল। বললাম, ‘‘ফড়েদের বদলে কোম্পানির চুক্তিচাষ তো ভাল। বেশি লাভ পাবেন হয়তো।’’ সবাই রে রে করে উঠলেন, ‘‘তখন আর এত কিছু পাবেন না। কোম্পানি যা বলবে, তাই। সিংঘুতে সবাই শীতে এমনি এমনি রাস্তায় বসে আছে?’’ কাটোয়া ব্লকের এই কৃষকেরা দেখছি, সিংঘু, গাজিপুরের খবরও রাখেন! স্থানীয় কৃষি সমবায় সমিতির মিঠুন ভট্টাচার্য শহুরে সাংবাদিকের ভুল ভাঙিয়ে দিলেন, ‘‘অবাক হচ্ছেন কেন? সবাই টিভি দেখেন। এখন হাল, বলদ, লাঙলে কম লোকেই চাষ করেন, বেশির ভাগই ট্রাক্টর।’’
পোড়ো ভিটেতেই বাংলার কৃষিতে এ ভাবে নতুন আলো দেখাচ্ছে কাশীরাম দাসের সিঙ্গি গ্রাম।
যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy