হাডসন পাড়ের নিউইয়র্কে যে ছবি, নলবন ধারের নিউটাউনেও তাই। আরকানসাসের ধারে লিটলরক শহরে যে ভাবে ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে বেসরকারি মেডিক্যাল ইউনিট, ক্যাপ্টেন ভেড়ির উল্টো দিকে মেট্রোপলিটন বাসস্টপের নামকরা ক্লিনিকেও প্রায় সেই দশা।
একে কোভিড আতঙ্ক, তায় লকডাউন। সরকারি, বেসরকারি নির্বিশেষে প্রায় সব মেডিক্যাল ইউনিটে উল্কাপতনের বেগে নেমেছে রোগীর সংখ্যা। সরকারি হাসপাতালে থাকলে উপার্জনের চিন্তাটা অন্তত নেই। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রাইভেট প্র্যাকটিসই যাঁদের সম্বল, করোনা অতিমারি বড়সড় সঙ্কটে ফেলেছে সেই চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের। রোগে আক্রান্তের সংখ্যা আমেরিকার চেয়ে অনেক কম এ মুলুকে। কিন্তু রোগের প্রভাবে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণটা একই রকম।
‘‘লকডাউনের আগে পর্যন্ত আমাদের ইমার্জেন্সিতে প্রতি ঘণ্টায় অন্তত ২৫টা পেশেন্ট থাকত। এখন ঘণ্টায় ৪-৫ জন,’’— বললেন বেহালার বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের এক চিকিৎসক। তবে এটুকু বলার পরেই আর কথা বাড়াতে চাইলেন না। ব্যস্ততার ভঙ্গি করে এক বার বাঁ হাতের কব্জিটা চোখের সামনে তুলে ধরে হাতঘড়িটার দিকে চোখ রাখলেন। তার পরে বললেন, ‘‘আচ্ছা, আর কথা বলার সময় নেই। খুব চাপ চলছে, বুঝতেই পারছেন। আবার পরে।’’ এবং এক নিঃশ্বাসে এই কথাগুলো বলে আর কোনও সুযোগই দিলেন না। হনহন করে করিডর ধরে এগিয়ে মিলিয়ে গেলেন ডান দিকের উইংয়ে।
আরও পড়ুন: জুন-জুলাইয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছবে করোনা পরিস্থিতি, আশঙ্কা এমস ডিরেক্টরের
শুধু বিদ্যাসাগর হাসপাতালে নয়, এ রাজ্যের যে কোনও সরকারি হাসপাতালের ছবিটা এখন এই রকমই। শীর্ষকর্তা হন বা চিকিৎসক, নার্স হন বা অন্য কোনও স্তরের স্বাস্থ্যকর্মী, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে সবাই খুব সচেতন। কোনও ঘোষিত বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু অলিখিত নির্দেশ প্রায় সবার কাছেই রয়েছে, বেশ কঠোর ভাবেই রয়েছে। অতএব কেউ খুব একটা মন খুলে কথা বলতে চাইছেন না। বললেও নাম প্রকাশে রাজি নন।
জীবাণুমুক্তির কাজ চলছে বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে।
অগত্যা এ বিভাগ, সে বিভাগে ঢুঁ মারতে হয়। নানা স্তরে কথা বলে সামগ্রিক ছবিটা পাওয়ার চেষ্টা করতে হয়। আর সেই সব টুকরো টুকরো তথ্য জুড়ে সামগ্রিক ছবিটা তৈরি করলেই বোঝা যায় যে, ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের অবস্থা সম্পর্কে যে হিসেবটা বিদ্যাসাগর হাসপাতালের ওই চিকিৎসক দিলেন, হাসপাতালগুলোর সামগ্রিক ছবিটাও সে রকমই।
সরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগীর চাপ থাকে জেনারেল মেডিসিন, অর্থোপেডিক (অস্থি), শিশুরোগ এবং অবস্টেট্রিকস (প্রসূতি) বিভাগের আউটডোরে। বিদ্যাসাগর হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগে আগে রোজ গড়ে ১৫০ জন রোগী হত। লকডাউন শুরুর পর থেকে তা ২০-২৫টায় নেমে গিয়েছিল। বুধবার অর্থাৎ ৬ মে শিশুরোগ বিভাগের আউটডোরে এক জন রোগীরও দেখা মেলেনি।
আরও পড়ুন: লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত বুমেরাং হবে না তো! আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের
কেন এই অবস্থা? কারণ মঙ্গলবার অর্থাৎ ৫ মে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে এক রোগীর করোনা টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। সে কথা চাউর হতেই পরের দিন আর হাসপাতালমুখো হতে চাননি কেউ।
জনশূন্য এসএসকেএম হাসপাতাল।
দক্ষিণ শহরতলি ছেড়ে এ বার ঠিক উল্টো প্রান্তে নজর দেওয়া যাক। উত্তর শহরতলির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। আউটডোরে রোজ সব বিভাগ মিলিয়ে কত রোগী আসতেন? চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, দেড় হাজারেরও বেশি। এখন সেই সংখ্যাটা কেমন? ‘‘লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমশ কমছিল। এখন সেটা ১০০, খুব জোর ১১০,’’— বললেন এক চিকিৎসক। শ’পাঁচেক রোগীর চাপ সামলাতে হত শুধু জেনারেল মেডিসিন বিভাগকেই। সেখানে এখন দিনে ৩০-৪০ জনের বেশি আসছেন না।
সাগর দত্ত হাসপাতাল যে এলাকায়, সেই কামারহাটিতে সংক্রমণ রয়েছে। কামারহাটির বেশ কিছু এলাকা কনটেনমেন্ট জোনে। তার উপরে আবার হাসপাতালেরই অন্তত ৪ কর্মী ইতিমধ্যেই কোভিডে আক্রান্ত। অতএব খুব প্রয়োজন না পড়লে সে হাসপাতালকেও এড়িয়েই চলতে চাইছেন রোগীরা।
আরও পড়ুন: কোভিড-যুদ্ধে নামতে কোমর বাঁধছে মেডিক্যাল
কিন্তু আসলে এই কাহিনি শুধু সাগর দত্ত বা বিদ্যাসাগর হাসপাতালের নয়। এই ছবি কয়েকটা মাত্র হাসপাতালে সীমাবদ্ধ কোনও বিচ্ছিন্ন ছবিও নয়। রাজ্যের সিংহ ভাগ হাসপাতালেই এই একই ছবি। মূলত করোনা আতঙ্কেই হাসপাতাল এড়িয়ে চলতে চাইছেন অনেকেই। সাগর দত্ত হাসপাতালের রেডিয়োলজি বিভাগের চিকিৎসক কুলদীপ বটব্যালের কথায়, ‘‘পেটে ব্যথার কারণ খুঁজতে হাসপাতালে গিয়ে যদি করোনা আক্রান্তের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! অনেকেই এ রকম ভাবছেন।’’ ওই চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এতটা আতঙ্কিত হওয়া উচিত হয়তো নয়। যত ক্ষণ না করোনা নির্মূল হচ্ছে, তত ক্ষণ কেউ অন্য কোনও রোগের চিকিৎসা করাবেন না, এটা তো কোনও কাজের কথা নয়। প্রয়োজন পড়লে চিকিৎসা তো করাতেই হবে। কিন্তু উচিত-অনুচিত নিয়ে এখন অনেকেই ভাবতে পারছেন না। কারণ আতঙ্ক তো একটা কাজ করছেই।’’ এ ছাড়া রয়েছে লকডাউন এফেক্ট। গণপরিবহণ ব্যবস্থা প্রায় পুরো বন্ধ। গাড়ি ভাড়া করে হাসপাতালে যেতে হলেই অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। সুতরাং একেবারে নিরুপায় না হয়ে পড়লে হাসপাতালে যাওয়ার আগ্রহ আপাতত কম।
হাওড়া জেলা হাসপাতাল।
যাঁদের মধ্যে করোনা বা ফ্লু জাতীয় অসুখের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, তাঁরা কিন্তু অবশ্যই সর্বাগ্রে হাসপাতালে ছুটছেন। কোভিড হাসপাতালগুলোয় বা বিভিন্ন হাসপাতালের ফিভার ক্লিনিকে ওই ধরনের রোগীদের ভিড় লেগে থাকছে রোজ। কিন্তু সে ভিড় হাসপাতালের স্বাভাবিক ভিড়ের তুলনায় কিছুই নয়। অতএব সব মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা কোনও হাসপাতালে পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমেছে, কোথাও রোগীর সংখ্যা কমে গিয়েছে ৯০ শতাংশ। ফিভার ক্লিনিকের হিসেবটা অবশ্য এর বাইরে।
প্রসূতি বিভাগগুলো অবশ্য এখনও কিছুটা ব্যস্ত। অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন কোনও জটিলতা তৈরি হলে সে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেই হচ্ছে। প্রসব বেদনা শুরু হলেও কাউকে বাড়িতে ফেলে রাখা সম্ভব নয়। ফলে প্রসূতি বিভাগ এখনও সুনসান হয়ে যায়নি। কিন্তু অন্যান্য বিভাগের আউটডোর অস্বাভাবিক রকম ফাঁকা।
বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোমেও একই অবস্থা। তার চেয়েও খারাপ অবস্থা ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের চেম্বারগুলোর। বাইপাসের ধারে সায়েন্স সিটির কাছাকাছি এলাকায় জমজমাট প্র্যাকটিস এক স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের। স্বাভাবিক সময়ে এতটাই চাহিদা তাঁর যে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার দু’-আড়াই মাস পরে ডাক্তারের মুখোমুখি হওয়ার তারিখ মেলে। এখন কী অবস্থা সেখানে? কোনও কোনও সপ্তাহে চেম্বার খুলতেই হচ্ছে না সেই স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞকে। শুধু কলকাতার রোগীরা নন, বাইরে থেকেও অনেক রোগী আসেন তাঁর চেম্বারে। তাঁদের পক্ষে লকডাউন ঠেলে কলকাতায় পৌঁছনো এখন খুব কঠিন। কলকাতার মধ্যে যাঁরা থাকেন, তাঁদেরও যে সবার নিজস্ব গাড়ি রয়েছে, এমন নয়। সুতরাং ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছনোর রাস্তা তাঁদের জন্যও খুব সহজ নয়। অতএব ডাক্তারের জমজমাট চেম্বার ফাঁকা। এক নামী ইএনটি (নাক-কান-গলা) বিশেষজ্ঞের কাঁকুড়গাছি এলাকার চেম্বারের অবস্থাও সে রকম। সে চেম্বারে নিজের সহকারী, টেকনিশিয়ান, রিসেপশনিস্ট ইত্যাদি মিলিয়ে কর্মীর সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে সেই কর্মীদের বেতনের টাকাটাই তুলতে পারছেন না ওই ইএনটি বিশেষজ্ঞ। নিজের উপার্জন তো আরও পরের কথা।
পিয়ারলেস হাসপাতাল।
শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের ছবি কিন্তু এটা নয়। দেশের সব রাজ্যেই পরিস্থিতি এই রকমই। ভয়ঙ্কর অতিমারির মুখে চিকিৎসকদের চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই অতিমারির চরিত্র এতটাই অন্য রকম যে, চিকিৎসকরাও সঙ্কটে। সে সঙ্কট অবশ্য দু’রকমের। সরাসরি কোভিডের চিকিৎসা যাঁরা করছেন, তাঁদের কাজের চাপ এবং মানসিক চাপ এই মুহূর্তে অপরিসীম। আর যাঁরা কোভিড চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদের অনেকেই রয়েছেন বেনজির আর্থিক চাপের মধ্যে।
ছবিটা আসলে শুধুমাত্র ভারতের ছবিও নয়। করোনায় মৃত্যুর এপিসেন্টার হয়ে উঠেছে এখন যে দেশ, সেই আমেরিকাতেও একই ছবি। একের পর এক মেডিক্যাল ইউনিট ধুঁকছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যমে তার বিশদ বিবরণও মিলছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা প্রাইমারি হেলথ ক্লিনিকগুলোর আয় এতটাই কমেছে এই লকডাউনের বাজারে যে, বাড়িভাড়া আর বিদ্যুৎ বিল মেটানোর সংস্থানও হচ্ছে না অনেক মেডিক্যাল ইউনিটে। বহু বছরের প্রতিষ্ঠা রয়েছে, এমন সব হেলথ কেয়ার ফেসিলিটি-ও কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে মার্কিন মুলুকে।
পরিস্থিতি কবে বদলাবে, নিশ্চিত ভাবে বলার জায়গায় নেই কোনও দেশই। করোনার প্রত্যক্ষ শিকারের সংখ্যা রোজ বাড়ছে। তার তালিকাও রোজ সামনে চলে আসছে। কিন্তু পরোক্ষে আর এক ধরনের শিকারও চালিয়ে যাচ্ছে এই অতিমারি। সেই তালিকায় তাঁরাও রয়েছেন, যাঁরা এই সঙ্কটে সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা।
নিজস্ব চিত্র।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy