Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
পাথর ভাঙা বিষ
Silicosis

Silicosis: ‘ভাত জুটুক না জুটুক, জোটাতেই হত অক্সিজেন’

কথোপকথনের মধ্যেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলেন হাফিজুর মোল্লা। বুকের হাড়গুলো গোনা যাচ্ছে। দম নিতে পারছিলেন না ভাল করে। কোনও মতে বললেন, ‘‘মাস কয়েক পরে যদি আবার এই গ্রামে আসেন, খোঁজ করলে অনেককেই আর পাবেন না। কে কবে শেষ হয়ে যাব জানি না।’’

সন্তানদের মৃত্যুর শংসাপত্র হাতে  বঙ্কিম মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র

সন্তানদের মৃত্যুর শংসাপত্র হাতে বঙ্কিম মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২২ ০৬:৪৫
Share: Save:

দুই সন্তানের ডেথ সার্টিফিকেট আঁকড়ে মেঝেতে বসে রয়েছেন বৃদ্ধ। অদূরে কয়েকটা ছেঁড়া কাগজের টুকরো নিয়ে একমনে খেলছে এক শিশু। বয়স বড় জোর সাত-আট। ভাল করে জ্ঞান হওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়েছে ছেলেটা। ওই বৃদ্ধ তার দাদু। যিনি বলে চলেছেন, ‘‘আমিই তো ছেলেদু’টোকে কাজের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। এ তো তা হলে আমারও পাপ!’’

এই হাহাকার শুনে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলেন যাঁরা, তাঁরা সকলেই সন্তানহারা বাবা-মা। আখের আলি মোল্লা, নুরউন্নেসা, মর্জিনা বিবি, রহিম মোল্লা, আয়েষা বিবি... তালিকাটা দীর্ঘ। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা নুরউন্নেসা তাঁর তিন সন্তানকেই হারিয়েছেন ওই রোগে। যার মধ্যে ছোট ছেলেটার বয়স ছিল ১৮ বছর। আর ওই বৃদ্ধ বঙ্কিম মণ্ডল নিজে জামুরিয়ার পাথর ভাঙার কারখানায় কাজ করতেন। আর গ্রাম থেকে জোয়ান ছেলেদের সেখানে নিয়ে যেতেন । এক টন পাথর গুঁড়ো করলে ২০০ টাকা। শক্তসমর্থ যুবকেরা অনেকেই দিনে দেড় থেকে দু’টন পাথর ভাঙতেন। আর সেই পাথর ভাঙা ধুলোর বিষ তিল তিল করে নষ্ট করত তাঁদের ফুসফুস। বঙ্কিম বা অন্য কেউই সেই কথা আগে বুঝতে পারেননি। ছেলেদের হারানোর পরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর নিজের শরীরেও কামড় বসিয়েছে ওই একই রোগ।

রাজ্য সরকার সম্প্রতি সিলিকোসিস রোগীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নীতি ঘোষণা করেছে। যে নীতিতে রোগ নির্ণয়, নিখরচায় চিকিৎসা, পৃথক পরিচয়পত্র, মাসিক পেনশন, সন্তানদের পড়াশোনার দায়িত্ব-সহ বহু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অন্য একাধিক রাজ্য যে নীতি আরও আগেই ঘোষণা করেছে, সেই নীতির বিলম্বিত ঘোষণার পরেও সরকারি কর্তারা একে নিজেদের কৃতিত্ব হিসেবেই প্রচার করতে শুরু করেছেন। কিন্তু যাঁদের সামনে রেখে এই প্রচার, কী অবস্থায় আছেন তাঁরা? উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁ ব্লকের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে মনে হল, মৃত্যুর গন্ধ ভারী করে রেখেছে সেখানকার বাতাস। খড়ে ছাওয়া সার সার জীর্ণ, মলিন বাড়ি। লাউমাচার ফুলও শুকিয়ে গিয়েছে। রান্নাঘর শুকনো খটখটে। রোজ হাঁড়ি চড়ে না। সংসারে শেষ কবে দু’বেলা সকলের মুখে ভাত জুটেছিল সে কথা মনে করতে পারেন না প্রায় কেউই। শিশুরা এক পেট খিদে নিয়ে পাড়া থেকে পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়।

আয়লা-র পরে চাষবাসের কাজ যখন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তখন রাজ্যের আরও কিছু এলাকার মতো উত্তর ২৪ পরগণার এই সব গ্রাম থেকেও বহু মানুষ কাজের খোঁজে ভিড় জমিয়েছিলেন পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূমের ওই সব কারখানায়, যার অধিকাংশই দূষণ এড়ানোর কোনও নিয়মকানুনই মানে না। নতুন জায়গায় গিয়ে কাজ জুটল ঠিকই, সংসারে পাঠানোর মতো কিছু টাকারও সংস্থান হল, কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই পর পর অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করলেন অনেকে। জ্বর, কাশি, মারাত্মক শ্বাসকষ্ট, গায়ে ব্যথা আর প্রবল দুর্বলতার মতো উপসর্গ নিয়ে। অভিযোগ, গোড়ায় প্রশাসনের তরফে এঁদের অনেককেই যক্ষ্মা আক্রান্ত বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তৎপরতা এবং কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনের সক্রিয়তার সামনে আসে রোগটার আসল পরিচয়। তত দিনে ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে মৃত্যুর পালা। কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনের হস্তক্ষেপে দীর্ঘ টালবাহানার পরে সরকারি তরফে কিছু মৃতের পরিবার চার লক্ষ টাকা আর কিছু আক্রান্তকে দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু মৃত বা আক্রান্তের প্রকৃত
সংখ্যার তুলনায় এই প্রাপকদের সংখ্যা নেহাৎই নগণ্য।

আর যে টাকাই জুটুক না কেন, বেশির ভাগ পরিবারেই তা নিঃশেষ হয়েছে দেনা মেটাতে। কীসের দেনা? ডাক্তার, ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার টাকা জোগাড়ের জন্য দেনা। শুধু দেনাই নয়, ওই টাকা জোগাড় করতে সম্বলের সামান্য জমিটুকুও বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। সরকারের এই নয়া নীতি কি পরিস্থিতিতে কিছুটা বদল আনতে পারে? পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী কুণাল দেব বললেন, ‘‘২০১৬ সালেও এমন অনেক প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল। আর্থিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি জেলা হাসপাতালগুলিকে নোডাল সেন্টার হিসেবে চিহ্নিত করা, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ, অনেক
কিছুই বলা হয়েছিল। বাস্তবে তার কিচ্ছু হয়নি।’’

হয়নি যে, তার প্রমাণ আনওয়ারা বেওয়ার মতো অনেকেই। আনওয়ারা তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন তিন বছর আগে। আট বছর ধরে কষ্ট পেয়েছিলেন তাঁর স্বামী সালাউদ্দিন মোল্লা। আনওয়ারা বললেন, ‘‘দম নিতে গিয়ে ছটফট করত মানুষটা। বাড়িতে সব সময়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে হত। দিনে তিন-চারটে সিলিন্ডার লাগত। এক-একটা সিলিন্ডারের জন্য হাজার টাকা। ভাত জুটুক না জুটুক, অক্সিজেন তো জোটাতেই হত।’’ তা জোটাতে গিয়েই সর্বস্ব বেচতে হয়েছে। রহিমা বিবির স্বামী রহমান আলি মোল্লা আর দেওর নুর হোসেন মোল্লা দু’জনেই সিলিকোসিসের বলি। রহিমা জানালেন, মারা যাওয়ার আগে শেষ তিন বছর তাঁর স্বামী কোনও কাজই করতে পারতেন না। গ্রামের লোকের টাকায় সামান্য খাবার জুটত। আর সঞ্চয়ের সবটাই খরচ হত
অক্সিজেন জোগাড়ে।

মিনাখাঁর গোয়ালদহ, দেবীতলার ঘরে ঘরে এই ছবি। নিরুফা বেগমের স্বামী আট বছর ভুগে তিন মাস আগে মারা গিয়েছেন। আক্রান্ত হিসেবে দু’লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু দিনে চারটে অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করতে গিয়ে সে টাকা বেশি দিন থাকেনি। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে নিরুফা বা তাঁর মতো অনেকেই শাড়িতে জরি-চুমকি বসানোর কাজ করেন। এক-একটি শাড়িতে এই কাজ শেষ করতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ দিন। শাড়ি পিছু মজুরি ৮০ টাকা। ‘‘এই টাকায় মাসে ক’দিন খাবার জোটে বলতে পারেন?’’ নিরুফার গলা বুজে আসে।

বাড়ি বাড়ি ঘুরে কথা বলার ফাঁকেই রাস্তা আটকান এক যুবক। ‘‘এই যে এত কথা জানছেন, জেনে ঠিক কী করবেন বলুন তো?’’ রুক্ষ স্বরের এই প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা পরিচয় জানতে চাইলে গ্রামের অনেকেই সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘‘ও আমাদের আপনজন। আমাদের জন্য দৌড়োদৌড়ি ও-ই করে।’’ আপনার পরিবারের কেউ সিলিকোসিস আক্রান্ত? ‘সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি’-র সদস্য ওই যুবক, সইদুল পাইক বললেন, ‘‘পরিবার? যাদের সঙ্গে আমি এই গ্রামে বড় হয়ে উঠেছি, তাদের কেউ আর বেঁচে নেই। সব শেষ ওই এক রোগে। ওদের পরিবার তো আমারও পরিবার। চোখের সামনে তাদের এ ভাবে শেষ হতে দেখব?’’ এক মুহূর্ত থেমে তিনি ফের বলেন, ‘‘অনেকেই গ্রামে আসে। কথা বলে, ছবি তুলে নিয়ে চলে যায়। তাদের কেউ কেউ নিজেদের প্রয়োজনে সেগুলো ব্যবহার করে। কিন্তু এখানকার অবস্থাটা বদলায় না। রোগ নির্ণয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কেউ কোনও দায়িত্ব নেয় না। আমরা নিজেরাই নিজেদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, যতটা পারি।’’

সেই পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টাতেই গোয়ালদহে গড়ে উঠেছে আবুল স্মৃতি সেবা কেন্দ্র। আবুল পাইক আর জাকির পাইক দুই ভাই। দু’জনেই
পাথর ভাঙার কারখানায় কাজ করতে গিয়েছিলেন। রোগ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। কিছু দিনের ব্যবধানে মারা যান দুজনেই। আবুল যে ঘরে থাকতেন, তাঁর মা সেই ঘরটি দান করেন। সেই ঘরেই দু’টি শয্যা, অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারও অবস্থা আচমকা খারাপ হলে সেখানে এনে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রামবাসীরাই নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করছেন। জানালেন, বহু আন্দোলনের পরে মিনাখাঁ হাসপাতালের তরফে মাসে এক দিন ওষুধ, ইনহেলার দেওয়া হয়। তাঁদের অভিযোগ, সেই ওষুধে দিন দশেকও চলে না। বাকিটা কিনতে হয়।

কথোপকথনের মধ্যেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলেন হাফিজুর মোল্লা। বুকের হাড়গুলো গোনা যাচ্ছে। দম নিতে পারছিলেন না ভাল করে। কোনও মতে বললেন, ‘‘মাস কয়েক পরে যদি আবার এই গ্রামে আসেন, খোঁজ করলে অনেককেই আর পাবেন না। কে কবে শেষ হয়ে যাব জানি না।’’

কলকাতা থেকে মিনাখাঁ-র দূরত্ব দেড় ঘণ্টাও নয়। দম বন্ধ হয়ে এখনও মানুষ মারা যাচ্ছেন সেখানে।

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Silicosis diseases
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy