প্রতীকী ছবি।
রাতের খাওয়া সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায়। এর পরে ফের খাওয়া জুটতে জুটতে পর দিন সকাল আটটা। অথচ ওষুধগুলো খেলে বড্ড খিদে পায় যে! সন্ধ্যায় তাই গোগ্রাসে খাওয়ার যেন ধুম পড়ে যায়! একসঙ্গে বেশি খেলে যদি রাতের দিকে খিদের কষ্টটা একটু কমে, সে জন্য একসঙ্গে অনেকটা খাবার মুখে পুরে ফেলেন কেউ কেউ। আবার খাবার নিয়ে বেশি ক্ষণ বসে থাকলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ধমক-ধামক, হাল্কা মারধরও জোটে। অভিযোগ, সেই সন্ধ্যায় এক সঙ্গে বেশি খাবার আর তাড়াতাড়ি তা শেষ করার ধমক— এই দুই-ই জুটেছিল বছর পঁচিশের ছেলেটির বরাতে।
ওই সময়ে ওয়ার্ডে উপস্থিত, সুস্থ হয়ে ওঠা একাধিক আবাসিক জানিয়েছেন, পাতের দুটো সেদ্ধ ডিম একসঙ্গে মুখে পুরেছিলেন ওই যুবক। ডিম গলায় আটকে যায়। অভিযোগ, শ্বাসরোধ হয়ে ছটফট করতে করতে যখন বছর পঁচিশের ওই যুবকের শরীরটা যখন নিথর হয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁকে বাঁচানোর কার্যত কোনও চেষ্টাই করা যায়নি। কারণ, আশপাশে তখন কোনও নার্স ছিলেন না। কলকাতার পাভলভ মানসিক হাসপাতালে সম্প্রতি এই ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, এমন কোনও ঘটনার কথা তাঁদের ঠিক ‘খেয়াল হচ্ছে না’! এ থেকেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি পাভলভ আছে পাভলভেই? উত্তর হল, না, শুধু পাভলভ নয়, সামগ্রিক ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যই আছে পুরনো হেলাফেলার জায়গাতেই।
অতিমারির সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি বার বার সামনে এসেছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি কতটা গুরুত্বহীন, তা বোঝা যায় রাজনৈতিক স্তরে তার উপেক্ষা দেখলে। কোনও রাজনৈতিক দলের প্রচার বা প্রতিশ্রুতিতে কখনও ঠাঁই পায় না মানসিক রোগীদের অবস্থার উন্নতির বিষয়টি।
আর তাই স্বাস্থ্য ভবনে যখন খবর পৌঁছয় পাভলভের ‘ওয়ান আননোন অজয়’-এর বেঘোরে প্রাণ গিয়েছে, তখন সে ভাবে আলোচনাই হয় না। সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের কথায়, ‘‘রাজনৈতিক নেতারা ভুলে যাচ্ছেন, মানসিক হাসপাতালে ভর্তি এই সব মানুষগুলোও কিন্তু ভোটার। তা হলে কেন অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে বার বার এঁরা বাদ পড়েন? সঠিক নজরদারি থাকলে, মানসিক রোগীদের খাবারের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পেলে এই মৃত্যু হয়তো এড়ানো যেত।’’ রত্নাবলীর বক্তব্য, ‘‘মানসিক রোগীদের মাসের পর মাস প্রেসক্রিপশন অডিট হয় না। ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে গলা শুকিয়ে যাওয়া, গলায় খাবার আটকে যাওয়ার ঘটনা তো আকছার ঘটে। তা হলে খাওয়ার সময়ে পাশে জল রাখা বা খাওয়ার জায়গায় যথাযথ নজরদারির ব্যবস্থা কেন হয় না? কেন গলায় কিছু আটকে গেলে বার করার জন্য সাকশন মেশিন থাকে না?’’
মনোরোগ চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদারও বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে মানসিক রোগের ওষুধ খেলে গলা শুকিয়ে যাওয়া বা গিলতে অসুবিধা হওয়া খুবই পরিচিত সমস্যা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের খাওয়ার সময়ে নজরদারি দরকার। আর ওষুধের ডোজ কমানো বা নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওষুধ বদলে দেওয়াটাও জরুরি।’’
মানসিক হাসপাতালে নিয়মিত প্রেসক্রিপশন অডিট যে হয় না, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের একটা বড় অংশও। এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘হাসপাতলে উপচে পড়ে ভিড়। ১০০ জনের ওয়ার্ডে আ়ড়াইশো জন থাকেন। ডাক্তারদের পক্ষেও সব সময়ে সম্ভব হয় না, প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে বেশি সময় দেওয়া। তাই এই সমস্যাটা চলতেই থাকে।’’ মনোরোগ চিকিৎসকদের বড় অংশই অবশ্য জানাচ্ছেন, মনোরোগীদের খাবারের পরিমাণ, কখন-কীভাবে তা দেওয়া হচ্ছে, কী খাবার দেওয়া হচ্ছে, কতটা নজরদারি থাকছে, সেই বিষয়গুলির উপরে নজর দেওয়া দরকার। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘স্বাস্থ্যকর্তারা বার বার বলেন, ওয়ার্ডে ভিড়। তা হলে সুস্থ হয়ে ওঠা যে মানুষদের বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া হয় না, তাঁদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ার উপরে কেন আরও জোর দেওয়া হয় না? পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবগুলো লক্ষ লক্ষ টাকা পায়, আর এই খাতে টাকা আসে না?’’
কেন বার বার দাবি তোলা সত্ত্বেও মানসিক হাসপাতালের সব তলায় নার্স রাখা হয় না, কেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রেসক্রিপশন অডিট হয় না, কেন ওষুধের কারণে মানসিক রোগীদের যে বেশি খিদে পায়, সে কথা মাথায় রেখে সাড়ে ছ’টা-সাতটায় রাতের খাওয়া দেওয়ার পরে ঘুমনোর আগে সামান্য খাবারের বন্দোবস্ত থাকে না, কেন মানসিক রোগীদের পরিচর্যার জন্য নার্স এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের বিশেষ ভাবে সংবেদনশীল থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না? প্রশ্নের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে ক্রমশ।
বছর দেড়েক আগে ওই পাভলভ হাসপাতালেই গলায় পাঁউরুটি আটকে মৃত্যু হয়েছিল এক রোগীর। ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়নি। বছর পাঁচেক আগে রাস্তা থেকে অজ্ঞাত পরিচয় যে যুবককে তুলে এনে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল পুলিশ, ভাঙা ভাঙা শব্দে নিজের নাম অজয় ছাড়া যিনি আর কিছুই বলতে পারেননি, হাসপাতালের খাতা থেকে সেই ‘আননোন-অজয়’-এর নামটাও মুছে গেল মনোরোগীদের প্রতি সমাজের সেই উপেক্ষার কারণেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy