Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
partha chatterjee

TMC: মহাসচিবের মহাতীর্থ, রাজনীতির নতুন পীঠস্থান

‘ঘর ওয়াপসি’-র প্রক্রিয়ায় পীঠস্থান হয়ে উঠেছে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাসভবন। সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন প্রত্যাবর্তনকামীরা।

তৃণমূলে ফিরতে চাওয়াদের ভিড় পার্থর বাড়িতে।

তৃণমূলে ফিরতে চাওয়াদের ভিড় পার্থর বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২১ ১২:২১
Share: Save:

বাড়ির নাম ‘বিজয়কেতন’। গৃহস্বামীর নাম পার্থ চট্টোপাধ্যায়তৃণমূলের সেক্রেটারি জেনারেল। মহাসচিব। ঘটনাচক্রে, সারা পৃথিবীতে বহুল পরিচিত মাত্র তিনটি সংগঠনেই ‘মহাসচিব’ পদটি রয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ, ফিকি এবং তৃণমূল। ইদানীং পার্থর নাকতলার বাড়িটি অবশ্য ‘মহাতীর্থে’ পরিণত হয়েছে। সেখানে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন বিজেপি থেকে তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনকামী নেতা-কর্মীরা। ডাকবিভাগের খাতায় বাড়ির ঠিকানা ৯/৪, খানপুর রোড।

‘মা-মাটিঃমানুষ’-এর সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পার্থ রাজ্যের মন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরেও তিনি তাঁর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। শিল্প এবং পরিষদীয় দফতর তাঁর হাতে। ওজনদার নেতা। দৈহিক এবং রাজনৈতিক। সর্ব অর্থেই। ওজন নিয়ে একসময় খুনসুটি করতেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কিন্তু আস্থাও রাখতেন পুরোমাত্রায়। বিরোধী দলনেতা থাকাকালীন সরকার পক্ষের সঙ্গে তিনিই ‘ট্র্যাক টু কূটনীতি’ বজায় রাখতেন। মিষ্টভাষী। তাঁকে কটূবাক্য বলতে খুব একটা শোনা যায় না। তা-ই সকলের সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক। আশ্চর্য নয় যে, ভোটের আগে তৃণমূলে কারও ‘দমবন্ধ’ হয়ে এলে তিনি যেমন বিজেপি-তে যাওয়ার আগে পার্থর বাড়িতে যেতেন, ভোট হেরে দম ফেলতে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরতে চেয়েও তিনি সেই পার্থর বাড়িতেই আসছেন।

ঘটনাচক্রে, গত রবিবার মাতৃবিয়োগ হয়েছে পার্থর। কয়েক বছর আগে স্ত্রী বাবলি চট্টোপাধ্যায় পার্থকে ছেড়ে পরলোকে চলে গিয়েছেন। স্ত্রী-র অবর্তমানে মা শিবানীদেবী ছিলেন পার্থর অভিভাবক। স্বভাবতই মা-কে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছিলেন পার্থ। লৌকিকতা এবং সামাজিকতা দেখিয়ে শোক প্রকাশ করতে তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থেরা পার্থর বাড়িতে গিয়েছেন। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তাঁর বাড়িতে গিয়েছেন প্রাক্তন তৃণমূল এবং অধুনা বিজেপি নেতারা। যাঁরা ভোটের বেশি আগে এবং অল্প আগে মমতাকে ছেড়ে নাম লিখিয়েছিলেন গেরুয়া শিবিরে। সেই তালিকায় এক নম্বরে নাম রয়েছে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি যখন তৃণমূল ছাড়ব-ছাড়ব করছেন, তখনও পার্থর সঙ্গে তাঁর একাধিক বার ফোনে কথা এবং মুখোমুখি বৈঠক হয়েছিল। তখন দলীনেত্রীর নির্দেশে পার্থই আগ্রহী ছিলেন রাজীবকে ধরে রাখতে। কিন্তু দু’দফা বৈঠকের পর কালীঘাটে যে রিপোর্ট তিনি দিয়েছিলেন, তাতে খুব আশাবাদী কিছু বলতে পারেননি। রাজীবও জোড়াফুলের বিধায়কপদে ইস্তফা দিয়ে মমতার ছবি বগলদাবা করে বিধানসভা থেকে বেরিয়ে পদ্মফুলে নাম লিখিয়েছিলেন।

দিন বদলেছে। বিধানসভা ভোটে নিজের কেন্দ্র ডোমজুড়ে হেরেছেন রাজীব। বেশ বড় ব্যবধানেই হেরেছেন। ফলে এখন বিজেপি-তে ‘দমবন্ধ’ লাগছে তাঁর। বিজেপি-র কড়া সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। তার পরেই চলে গিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের বাড়িতে। অবশ্য তার ‘আনুষ্ঠানিক’ কারণ ছিল তাঁর এক অনুগামীর অসুস্থ মা-কে দেখতে আসা। সঙ্গে ‘সৌজন্য’। সেই ‘সৌজন্য’ দেখা গিয়েছে পার্থর বাড়িতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও। রাজ্য মন্ত্রিসভায় প্রাক্তন সহকর্মীর মাতৃবিয়োগের জন্য শোকপ্রকাশের জন্য ফুল-মিষ্টি নিয়ে রবিবারেই পার্থর বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছেন রাজীব। তৃণমূলে ফেরার বাসনা নিয়ে পার্থর সঙ্গে তাঁর কোনও আলোচনা হয়নি বলেই দাবি করেছেন রাজীবের ঘনিষ্ঠরা। কিন্তু কে না জানে, দুই রাজনৈতিক নেতার মধ্যে আলোচনা হলে তা শুধু ‘সৌজন্য’-এর খাতিরে হয় না। বস্তুত, তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘দু’জন রাজনীতিকের মধ্যে দেখা হলে রাজনীতির কথা হবে না, সেটা কি কখনও হয় নাকি!’’

রাজীব গেলে কি অন্যরা আর পিছিয়ে থাকেন? রাজীবের পরে পরেই মাতৃবিয়োগের জন্য পার্থকে শোক জ্ঞাপন করতে সোমবার নাকতলায় যান শোভন চট্টোপাধ্যায়-বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। বাড়িতে ঢোকার আগে পার্থর পা ছুঁয়ে প্রণামও করেন বৈশাখী। ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ সেরে বেরিয়ে বৈশাখী যা বলেন, তার মধ্যে এই বার্তা স্পষ্ট যে, তৃণমূলে ফিরতে তাঁরা গররাজি নন। শোভন বলেন, নারদ-কান্ডে গ্রেফতার হওয়ার পর মমতা যে ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলন, তাতে তাঁরা কৃতজ্ঞ। আর বৈশাখীর বক্তব্য, মমতার সঙ্গে শোভনের সম্পর্ক পারিবারিক ও ব্যক্তিগত। তাঁর কথায়, ‘‘শোভন গ্রেফতার হওয়ার সময় উনি (মমতা) অন্য তিনজনের (সুব্রত মুখওপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম এবং মদন মিত্র) মতোই ওকে নিয়েও সমান উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত ছিলেন।’’ পার্থর বাড়িতে সোম-সফরের পরেই শোভন-বৈশাখীর তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন নিয়ে একইসঙ্গে জল্পনা এবং জলঘোলা শুরু হয়েছে।

এর মধ্যেই মঙ্গলবার ‘ছোটবেলার বন্ধু’ পার্থর বাড়িতে পুত্র শুভ্রাংশুকে নিয়ে হাজির হয়ে ছিলেন মুকুল রায়। যিনি গত শুক্রবারেই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরে এসেছেন। ফিরে এসেছেন শুভ্রাংশুও। সে দিক থেকে তাঁদের দলীয় সহকর্মীর বাড়িতে যাওয়া অস্বাভাবিক বা তাৎপর্যপুর্ণ নয়। কিন্তু তৃণমূল সূত্রের খবর, মুকুলের সঙ্গে ছিলেন বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরতে ইচ্ছুকদের একাংশও। ঘটনাচক্রে, মুকুল-শুভ্রাংশুর সঙ্গেই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরতে চেয়েছিলেন মুকুলের বেশকিছু অনুগামী। কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নেননি তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্ব। বস্তুত, তাঁদের নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি। এর মধ্যএ কয়েক জন মুকুলের সঙ্গে তৃণমূল ভবনে যাওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন। কিন্তু সেদিন কোনও লাভ হবে না বুঝে পিছিয়ে আসেন। সেদিনের মতো হতাশ হয়ে পড়লেও তাঁরা হাল ছাড়েননি। ফলে মুকুলের সঙ্গে সেঁটে তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ‘মহাসচিবের মহাতীর্থে’ পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের পীঠস্থানের বাইরেই থাকতে হয়েছে।

ঘটনাচক্রে, পার্থর বাড়িতে সোমবার গিয়েছিলেন বিজেপি-র বিধায়ক মনোজ টিগ্গাও। তবে তিনিও তৃণমূলে যেতে চান, এমন কোনও খবর নেই। মনোজের বক্তব্য, ‘‘মা হারানোর যন্ত্রণা আমি বুঝি। তাই গিয়েছিলাম সমবেদনা জানাতে। তা ছাড়া উনি তো বিধানসভায় আমার সিনিয়র সহকর্মী।’’

পার্থ নিজে কী বলছেন?

শোকের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে এলে কাউকে তো ফেরাতে পারেন না। পার্থর বাড়িতে তাই ‘বিক্ষুব্ধ’ বিজেপি নেতাদের অবারিত দ্বার। আর মহাতীর্থস্থান তো কাউকে ফেরায়ও না। অনুতপ্তদের বরং বেশি করে ঠাঁই দেয়। কিন্তু অনুতাপীদের ভিড় এত বাড়ছে যে, দলীয় সতীর্থরাও ইচ্ছেমতো পৌঁছতে পারছেন না নাকতলার ‘বিজয়কেতন’-এ। শোক জানাতে যাবেন বলে ফলফলাদির বরাত দিয়ে তৃণমূলে দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং প্রথম সারির নেতা সোমবার পার্থকে বলেছিলেন, মঙ্গলবার তাঁর বাড়িতে দেখা করতে যাবেন। মহাতীর্থের মহাসচিব তাঁকে বলেছেন, ‘‘আসার আগে একটা ফোন করে আসিস। বিজেপি-র কে যে কখন হুটহাট করে এসে পড়ছে!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy