গাছ থেকে নামানো হচ্ছে রসের হাঁড়ি। নিজস্ব চিত্র
শীতকাল, কাঁটা, রস এগুলো তো জীবন, কাব্য এ সবেরও অনুষঙ্গ! আর বাস্তবে শীতকালে খেজুর রস সংগ্রহ করতে গিয়ে যাঁরা আবহাওয়া নামের ‘কাঁটা’র সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন, কেমন আছেন তাঁরা?
মেটে রঙের হাঁড়ি ভরে আছে হালকা সোনালি তরলে। জ্বাল দিলে তার রঙ আরও গাঢ় হবে। কিন্তু এ বার সেই ‘সোনালি তরল’ নলেন গুড় সরবরাহ করতে গিয়েই বিপাকে পড়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের খেজুর গুড়ের ব্যবসায়ীরা।
প্রতি বছর শীতের মরসুমে খেজুর গুড়ের চাহিদা তুঙ্গে। এ বারও তার ব্যতিক্রম নেই। পৌষ-মাঘের মিলনলগ্নে বাউনি বাঁধে গোটা গ্রাম। শুরু হয় পিঠে-পুলি উৎসব। আনন্দ আরও মিঠে হয় সেই সোনালি রসের ধারায়।
খেজুরের রস ফুটিয়ে চলছে নলেন গুড় তৈরি। নিজস্ব চিত্র
তবে খেজুরের রসের নিয়ম একটাই। যত ঠান্ডা তত বাড়ে রসের উৎসস্রোত। কিন্তু চলতি শীতের মরসুমে ক্ষণে ক্ষণে লেখা হচ্ছে উলটপুরাণ। খলনায়ক খামখেয়ালি আবহাওয়ার শ্বাস-প্রশ্বাসে কখনও উত্তুরে হাওয়ার শীতলতা, কখনও মৃদু হলকা। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় রসের জোগান কম এ বার। ফলে নলেন গুড় কম পড়িয়াছে। তার জেরে ব্যবসায় বিনিয়োগ করে এখন মাথায় হাত নলেন গুড় ব্যবসায়ীদের।
গোয়ালতোড়ের কিয়ামাচায় ১২ বছর ধরে গুড়ের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বাঁকুড়ার বৈতলের বাসিন্দা এক্রামুল মল্লিক। কিয়ামাচা ছাড়াও গোয়ালতোড় এবং শালবনিতেও তিনি গুড় তৈরি করেন। এক্রামুলের কথায়, ‘‘প্রতি বছরই লাভ করে বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু এ বছর লাভ তো দুরের কথা, মহল করতে যে টাকা খরচ হয়েছে, গুড় বেচে সে টাকা তোলা দায়।’’ খরচের ফিরিস্তি দিয়ে এক্রামুল বললেন, ‘‘একটি মহল তৈরি করতে নতুন হাঁড়ি কেনা, হাতিয়ার বানানো, খাওয়া দাওয়া মিলিয়ে এক সিজনে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। তার উপর গাছ মালিকদের গাছ পিছু ৪ কিলোগ্রাম করে গুড় দিতে হয়। ফলে চারটি মহল তৈরি করতে যে খরচ হয়েছে তাতে ক্ষতি ছাড়া আর কিছু দেখছি না।’’
এক্রামুলের মতো অবস্থা বেলবনির ঝটু সরেন বা গুলজার আলি খানদেরও। গোয়ালতোড়ের পড়াকানালির অনিল বাস্কে যেমন বলেই দিলেন, ‘‘কনকনে ঠান্ডা না পড়ায় গাছ থেকে রস উপযুক্ত মানের রস পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যাচ্ছে তার থেকে উন্নত মানের গুড় তৈরি হচ্ছে না।’’ অনিল শীতকালে খেজুর গাছ ভাগে নিয়ে গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন৷ এ বছর তিনি গাছ পিছু ৪ কিলোগ্রাম গুড়ের চুক্তিতে ১৩০ টি গাছ ভাড়া নিয়েছেন। দৃষ্টিটা সামনের দিকে মেলে তিনি বলেই ফেললেন, ‘‘এ বার তো ক্ষতি ছাড়া আর কিছু দেখছি না।’’
আঁচে ফোটানোর পর তৈরি গুড়। নিজস্ব চিত্র
বিক্রেতারা বিপাকে। ভাল গুড় না পেয়ে আবহাওয়াকে দুষছেন খোলা বাজারের থেকে সস্তায় গুড় কিনতে আসা ক্রেতারাও। বছর কুড়ি ধরে খেজুর গুড়ের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন গোয়ালতোড়ের উত্তম মাহাতো। তেতো মুখে উত্তম বললেন, ‘‘গত বছর এই সময়ের মধ্যে ৫ থেকে ৬ কুইন্টাল খেজুর গুড় বিক্রি করে ফেলেছিলাম। এ বার এখনও ২ কুইন্টাল গুড় বিক্রি করে উঠতে পারিনি। কারণ গুড় তৈরির হচ্ছে কম।’’
উত্তমের সঙ্গে কথায় কথায় খেজুর গাছের পাতায় আলতো আলো বুলিয়ে তড়িঘড়ি পড়ে যায় শীতের বেলা৷ জঙ্গলমহলের বাতাসে ভেসে বেড়ায় ‘গুমোট’, এ বার লাভ হবে তো? শীত কবে আসবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy