মহুয়া মৈত্র। —ফাইল চিত্র।
মাত্র দু’টি ভোট। এই ব্যবধানেই তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পদ খারিজের সুপারিশ লোকসভার স্পিকারকে পাঠাতে চলেছে এথিক্স কমিটি। কিন্তু মহুয়ার জীবনে এই প্রথম ‘দুই’ নয়। ইতিহাস বলছে, মহুয়াকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্কে ‘দুই’ সংখ্যার অনুপ্রবেশ এই নিয়ে তৃতীয় বার। কখনও দু’পয়সা, কখনও দু’কোটি টাকা। আবার কখনও সাংসদ পদ খারিজের সুপারিশে এথিক্স কমিটিতে দুই ভোট!
মহুয়ার ঘনিষ্ঠ এবং হিতৈষীরা অবশ্য একে ‘কাকতালীয়’ বলেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, এ এক কৌতুককর তুলনা। সমাপতন তো বটেই। তবে মহুয়া নিজে মনে করেন, তিনি ‘বিতর্কিত’। তাঁকে নিয়ে বিতর্ক হবে। কারণ, তিনি প্রথাসিদ্ধ ভঙ্গিতে কিছু করেন না।
দু’পয়সার সাংবাদিক
২০২০ সালের ডিসেম্বরে মহুয়ার একটি বক্তব্য তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল রাজ্য রাজনীতিতে। তখন মহুয়া কেবল সাংসদ নন, তৃণমূলের নদিয়া জেলার সভানেত্রীও। একটি সাংগঠনিক কর্মসূচিতে কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া সংবাদমাধ্যমকে নিশানা করেছিলেন। গয়েশপুরের এক কর্মিসভায় মহুয়া পৌঁছলে দলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বচসা বাধে। মহুয়া বিবদমান দুই গোষ্ঠীকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বৈঠক শুরু করেন। কিন্তু ‘অভ্যন্তরীণ’ বৈঠকে সংবাদমাধ্যমের কয়েক জন প্রতিনিধি ঢুকে পড়েছিলেন। তখনই মেজাজ হারিয়ে মহুয়া দলের নেতা-কর্মীদের কাছে জানতে চান, দলীয় বৈঠকে সংবাদমাধ্যমকে ঢোকার অনুমতি কে দিয়েছেন! উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘কে এই দু’পয়সার প্রেসকে ভেতরে ডাকে? কর্মিবৈঠক হচ্ছে। আর সবাই টিভিতে মুখ দেখাতে ব্যস্ত! আমি নির্দেশ দিচ্ছি, প্রেসকে সরান!’’ মহুয়ার সেই বক্তব্য ছড়াতে বিশেষ সময় লাগেনি। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন তৃণমূল সাংসদের কড়া নিন্দা করেছিল। তার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সভায় বলেছিলেন, ‘‘প্রেস-মিডিয়ার একটা সম্মান আছে। যদি কেউ মনে করে টাকার প্যাকেট দিয়ে সবাইকে কিনবে, তা হলে বলব বাংলায় সবাইকে কেনা যায় না।’’ অনেকে মনে করেন, মহুয়াকে লক্ষ্য করেই দলনেত্রী ওই মন্তব্য করেছিলেন। যদিও মমতা কারও নাম করেননি। তবে অধুনাপ্রয়াত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূল সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সম্মান করে। মহুয়ার বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত। দলের বক্তব্য নয়।’’ তৎকালীন তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও নাম করেই সমালোচনা করেছিলেন মহুয়ার।
দু’কোটি ঘুষ
ঘটনাচক্রে, মহুয়ার বিরুদ্ধে ‘ঘুষ নিয়ে প্রশ্ন’ তোলার অভিযোগ উঠেছে। সেই অভিযোগেরই একটি অংশ হল, মহুয়া দুবাইয়ের ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানির থেকে দু’কোটি টাকা নগদ নিয়েছেন। তৃণমূলের সাংসদ যদিও ইতিমধ্যেই দাবি করেছেন, দর্শন তাঁর বন্ধু। কখনও জন্মদিনের উপহার হিসাবে স্কার্ফ, লিপস্টিক বা আইশ্যাডো উপহার পেয়েছিলেন। কিন্তু দু’কোটি টাকা নগদ নেওয়ার কথা একেবারেই ভিত্তিহীন। বিতর্কের মধ্যেই মহুয়া তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এবং মহিয়ার প্রাক্তন বান্ধব জয় অনন্ত দেহাদ্রাইকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন, ‘‘কোথায় কবে দু’কোটি টাকা নিয়েছি প্রমাণ করুক দেখি!’’ প্রসঙ্গত, নিশিকান্ত বা জয় দু’জনেই দু’কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ বার বার তুলেছেন, তা অবশ্য নয়। মহুয়ার ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, প্রমাণ নেই বলেই দু’কোটি টাকার অভিযোগ বার বার তোলা হয়নি। তবে মূল যে বিতর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন’ বিষয়টিই। যদিও মহুয়া বলছেন, আসলে বিষয়টি ‘অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন না-করা’।
দুই ভোট
মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি লোকসভার এথিক্স কমিটির কাছে পাঠিয়েছিলেন স্পিকার ওম বিড়লা। সেই কমিটির ‘তৎপরতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী শিবির। রাজনৈতিক দূরত্ব ঘুচিয়ে মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন কংগ্রেস এবং সিপিএমের নেতারা। বৃহস্পতিবার এথিক্স কমিটির বৈঠকে ৫০০ পাতার খসড়া রিপোর্ট চূড়ান্ত হয়। রিপোর্টের নির্যাস, মহুয়াকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হোক। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ছ’টি। বিপক্ষে চারটি। দু’টি ভোটের ব্যবধানে মহুয়াকে বহিষ্কারের সুপারিশে সিলমোহর পড়ে। সেই দুই!
তবে তাঁকে সাংসদ পদ থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ নিয়ে মহুয়ার কটাক্ষ, ‘‘আমি খুব সম্মানিত বোধ করছি এই কারণে যে, ইতিহাসে আমিই প্রথম, যাঁকে এথিক্স (নীতিনির্ধারক) কমিটি আনএথিক্যালি (অনৈতিক ভাবে) বহিষ্কারের সুপারিশ করেছে।’’ তাঁর কথায়, এথিক্স কমিটি কখনও বহিষ্কারের সুপারিশ করতে পারে না। তা করার এক্তিয়ার রয়েছে কেবলমাত্র সংসদের স্বাধিকাররক্ষা (প্রিভিলেজ) কমিটির। এই সুপারিশ যাবে লোকসভার স্পিকারের কাছে। স্পিকার সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিন এটি পেশ করবেন। তার পর আলোচনা হবে। ভোটাভুটিও হতে পারে। তবে ভোটে সংখ্যাধিক্যের জেরে সরকার পক্ষই জিতবে। অর্থাৎ, ডিসেম্বরেই মহুয়া সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হতে পারেন। মহুয়ার কথায়, ‘‘৫০০ পাতার রিপোর্টে কোথাও নগদ অর্থ নেওয়ার বিষয়ে প্রমাণ দেওয়া হয়নি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy