সোমবার রাতের রিষড়া স্টেশন। ট্রেনের বাইরে যাত্রীদের অপেক্ষা। ছবি: দেবদত্তা রায়
ঠিক দু’মিনিট। ওই দু’টো মিনিটের আফসোস সারা রাত হয়েছে আমার। আবার এটাও ঠিক যে, ওই দু’টো মিনিটই আমাকে একটা টান টান, গায়ে কাঁটা দেওয়া অভিজ্ঞতার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। সাংবাদিকতার পেশায় যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার সৌভাগ্য (না কি দুর্ভাগ্য!) আগে হয়নি কখনও।
অফিসে দেরি হয়েছিল। কাজ গুছিয়ে পৌনে ন’টা নাগাদ বেরোলাম ৯টা ১০-এর ব্যান্ডেল লোকাল ধরব বলে। হাতে ২৫ মিনিট। তবে হিসাব করে দেখলাম, ট্যাক্সি নিলে পৌঁছে যেতেই পারি। কিন্তু কপালে দুর্ভোগ যে তত ক্ষণে লেখা হয়ে গিয়েছে, কে জানত! হাওড়া স্টেশনের সামনে ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল ৯টা ৯ মিনিটে। দৌড়ে ভিতরে যখন পৌঁছলাম, তখন স্টেশন ভোঁভাঁ, প্ল্যাটফর্মেই নেই ট্রেন। ঘড়িতে দেখলাম ৯টা ১২। মনে মনে ভারতীয় রেলের মুন্ডুপাত করতে করতে (লেট না করার জন্য, অন্য দিন লেট করার জন্যও করে থাকি) গিয়ে উঠলাম সাড়ে ৯টার ব্যান্ডেল লোকালে।
গন্তব্য বৈদ্যবাটি। ১০টা ৫ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানও ছিল। সবাই অপেক্ষা করছিল আমার জন্যই। রাত সাড়ে ১২টার সময় রিষড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছিল একটি ইংরেজি প্রবাদ, ‘ম্যান প্রোপোজ়েস, গড ডিসপোজ়েস’। বাংলায় বললে, ‘মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক!’ তবে ইংরেজি প্রবাদের ওই অদৃশ্য ব্যক্তির কলকাঠি নাড়ার ভূমিকা এই সব ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
রিষড়া পর্যন্ত পৌঁছতে কোনও অসুবিধা হয়নি। বরং ট্রেন স্বাভাবিক ছন্দেই থামছিল, আবার এগোচ্ছিল। কিন্তু রিষড়ায় পৌঁছে স্টেশনে থামার পর থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সাধারণত প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ৩০ সেকেন্ড মতো থামে। এক-দেড় মিনিট থামলেই মনে হয় অনেক ক্ষণ থেমেছে। রিষড়ায় ট্রেনটা ৩-৪ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকায় অফিসফেরতা মানুষজন একটু বিরক্তিই প্রকাশ করছিলেন। আচমকাই দুমদাম আওয়াজ! কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম, ট্রেনের মহিলা বগির সমস্ত যাত্রী ছোটাছুটি করে বগির শেষ দরজার কোণে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। তাঁদের চোখে-মুখে আতঙ্ক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার শোনা গেল, ‘‘দরজা-জানলা বন্ধ করে দিন।’’ মুহূর্তে ঝপাঝপ বন্ধ করে দেওয়া হল কম্পার্টমেন্টের সমস্ত দরজা-জানলা। রাতের ট্রেনে জানলার ধারের ভাল ‘সিট’ আমিও পেয়েছিলাম। কোনও মতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘কী হয়েছে?’’ উত্তর দেওয়ার বদলে এক ভদ্রমহিলা প্রায় হামলে পড়ে আমার পাশের জানলাটি বন্ধ করলেন। তখনও জানি না কী হয়েছে। শুধু দুমদাম শব্দ কানে আসছে। লোকাল ট্রেনের লেডিজ় কম্পার্টমেন্টে রাতের দিকে একজন নিরাপত্তারক্ষী থাকেন। তাঁকেও দেখলাম সামনের দরজাটা বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু দরজা বন্ধ হচ্ছে না। কাচের জানলা দিয়ে চোখে পড়ল, কেউ প্ল্যাটফর্ম দিয়ে প্রাণপণে ছুটছে। সত্যি বলতে, ঠিক সেই সময়ে বুকটা একটু কাঁপল!
বন্ধ না হওয়া লোহার দরজার ছিটকিনিটার দিকে তাকিয়েই এক আতঙ্কিত যাত্রীর কাছে আবার জানতে চাইলাম, ‘‘কী হয়েছে বলবেন?’’ একজন বললেন, ‘‘মারছে।’’ আর একজন বললেন, ‘‘ট্রেনের সামনে বোমা পড়ছে। খুব গন্ডগোল হচ্ছে বাইরে।’’ সে কথা শুনেই কি না জানি না, হঠাৎ পাশে বসা এক যাত্রী সশব্দে কেঁদে উঠলেন। কী করব বুঝতে না পেরেই ফোন করলাম অফিসে। জানালাম পরিস্থিতি। তার পরেই রিষড়া স্টেশনেই শোনা গেল ঘোষণা, ‘‘বাইরে অশান্তির জন্য আপ এবং ডাউন দু’দিকের ট্রেন চলাচলই আপাতত বন্ধ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ট্রেন চলবে না।’’ কিন্তু পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হবে? অফিসফেরতা যাত্রীদের উদ্বেগ তখন চরমে। প্রত্যেকেরই মোবাইলে ঘন ঘন ফোন আসছে। সারাদিন ধরে কাজের পর সেই ফোনেও ব্যাটারি ডুবুডুবু। তার মধ্যেই চলছে খবর দেওয়া। আশ্বস্ত করা। দরজা-জানলা বন্ধ লেডিজ় কম্পার্টমেন্টে এ ভাবেই কাটল আধ ঘণ্টা। মনে মনে তখন ভাবছি, আর কতক্ষণ! পরিস্থিতি কি আরও বিগড়োতে পারে? তত ক্ষণে ফোনে চার্জ নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ১০ পার্সেন্টে। এর পর খারাপ কিছু হলে বাড়িতে খবর দিতে পারব তো! এই সব ভাবনার মধ্যেই দেখলাম একটু একটু সাহস করে স্টেশনে হাঁটাচলা করছেন কেউ কেউ। একজন হকার এক ক্রেট ডিম সিদ্ধ নিয়ে হাজির। কী হয় না হয় ভেবে দু-তিনটে ডিম কিনেও নিলাম। দেখলাম হকারদের অনেকেই খাবার নিয়ে উঠছেন। স্টেশন চত্বরের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। অনেকেই খাবার কিনলেন। তবে খাবার পেলেও জল নেই অনেকের কাছেই। প্ল্যাটফর্মে জলের কল আছে। কিন্তু কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে সেই জল ভরার সাহস নেই কারও।
তত ক্ষণে টুকটাক খবর আসতে শুরু করেছে। জানা গিয়েছে এই সাড়ে ন’টার ব্যান্ডেল লোকালের সামনেই লাইনের উপর নাকি বোমাবাজি চলছে। জায়গাটা রিষড়ার চার নম্বর গেট। শুনলাম, ডাউনের একটি ট্রেনে ইটপাথরও ছোড়া হয়েছে। মনে মনে ভাবছিলাম, ট্রেনে চেপে উপার্জনের জন্য আসা মানুষগুলোরই যত দুর্ভোগ। কত সহজে তাদের শান্তি নষ্ট করা যায়। সারাদিন পরিশ্রমের পরও তাঁরা শান্তিতে বাড়ি ফিরতে পারবেন না! স্টেশনে তখন ঘোষণা— ‘‘আপনারা ট্রেনের ভিতরেই শান্ত হয়ে বসে থাকুন। ট্রেন ছাড়ার আগে জানিয়ে দেওয়া হবে।’’
ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা। ক্রমাগত একই ঘোষণা হচ্ছে রিষড়া স্টেশনে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ট্রেন চলবে না। জলের জন্যও শুরু হয়েছে হাহাকার। একটা সময় ঘোষণা করতে শোনা গেল, ‘‘স্টেশনের সামনের অংশের দু-একটি কল ছাড়া বাকি সব কলেই জল পড়ছে। আপনারা এই জল খেতে পারেন।’’
এক সহকর্মীও ছিলেন একই ট্রেনে। তাঁকে প্ল্যাটফর্মে দেখে নামলাম। স্টেশনে দাঁড়িয়েই শুনতে পেলাম বিকট আওয়াজ। ক্রমাগত হলুদ আলোয় ঝলসে উঠছে আকাশ। পেশার কারণেই ভাবলাম ছবি তুলে পাঠানো গেলে অফিসে সুবিধা হত। তত ক্ষণে আমাদের ফোনে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে খবরও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সেই খবর দেখার উপায় নেই। উপায় নেই ছবি পাঠানোরও। অফিসেই ফোন করে কথা বলছিলাম, মিনিট তিনেক কথা বলেছি। তার মধ্যেই অন্তত চার-পাঁচ বার ঝলসে উঠতে দেখলাম আকাশ। মনে হচ্ছিল এ কি আজ সারা রাতই চলবে?
সৌভাগ্যের কথা, সারা রাতের ভোগান্তি হল না। রাত ১টা নাগাদ রিষড়া স্টেশনে ঘোষণা করা হল, ‘‘আপনারা ট্রেনে গিয়ে বসুন, ট্রেন একটু পরেই ছাড়বে।’’ উঠে বসলাম। দেখলাম সহযাত্রীদের মুখে তখনও অনিশ্চয়তা। সত্যিই ছাড়বে তো ট্রেন! ঠিক ১টা ৮ মিনিটে ট্রেন ছাড়ল। হইহই করে উঠলেন ট্রেনের যাত্রীরা। বাড়িতে পৌঁছলাম তারও মিনিট ৪০ পরে। ফোন বন্ধ। বাড়ি ঢুকে আগে ফোন চার্জে বসালাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy