বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। ফাইল চিত্র।
প্রজাতন্ত্র দিবসে রাজভবনে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের অনুষ্ঠান কার্যত বয়কট করল বিজেপি। এ ক্ষেত্রে সামনে রাখা হয়েছে রাজ্যপালের ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠানকে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাজ্যপাল বোসের ভূমিকা নিয়ে নানা ভাবে কটাক্ষ করছে তারা। রাজ্যপাল তাদের সঙ্গে ‘সহযোগিতা’ করছেন না বলেও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে বিজেপি শিবির থেকে। এ বার শিক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগকে সামনে রেখে রাজভবনের অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকলেন বিজেপি নেতারা। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে, রাজভবনকে দলীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারার হতাশা থেকেই কি বিজেপি নেতারা এমন আচরণ করছেন?
রাজভবনে বৃহস্পতিবার বিকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে রাজ্যপাল বোসের হাতেখড়ি অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগেই সমাজমাধ্যমে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে শুভেন্দু জানান, করদাতাদের টাকায় এমন একটি ‘অযাচিত ও হাস্যকর’ মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে চান না। রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানকে এক সূত্রে এনে এ দিন তোপ দেগেছেন শুভেন্দু। তাঁর অভিযোগ, শিক্ষা দফতরে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যখন চাপান-উতোর চলছে, টাকার বিনিময়ে শিক্ষকের চাকরিতে নিয়োগ হচ্ছে, তখন ঘটা করে এই সমস্ত অনুষ্ঠান করে সকলের নজর ঘোরানোর চেষ্টা করছে রাজ্য সরকার। অনুষ্ঠানের আগেই তাঁর বক্তব্য, ‘‘মনে হচ্ছে, এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার মূলে রয়েছে রাজ্য সরকার। আমি মনে করি, এই অনুষ্ঠান রাজ্যপালের আসন এবং রাজভবনের মর্যাদাকে বাড়াবে না।’’
এই বিতর্কের মধ্যেই এ দিন সন্ধ্যায় অন্য একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে শুভেন্দু মন্তব্য করেন, ‘‘জানি, উনি (রাজ্যপাল) রাতেই দিল্লি যাচ্ছেন। শুক্রবার রাজধানীতে ওঁর সঙ্গে অনেক বিশিষ্ট মানুষের দেখা ও কথা হবে।’’ রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ আবার টুইট করে পাল্টা দাবি করেছেন, ‘‘রাজ্যপালের দিল্লি সফর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি। তা গোপন করে যাঁরা অন্য গল্প দিচ্ছেন এবং তলবজনিত চিত্রনাট্য লিখছেন, সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’’ সরকারি ভাবে রাজ্যপালের দিল্লি-সফর নিয়ে কোনও কথা বলা না হলেও শাসক-বিরোধী টানাপড়েনের মাঝে বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়েছে।
রাজভবনের অনুষ্ঠানে এ দিন আমন্ত্রিত ছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও। তাঁকেও রাজভবনে দেখা যায়নি। তিনি জানিয়েছেন, বালুরঘাটে সরস্বতী পুজোয় মেয়ের হাতেখড়িতে ছিলেন। তবে বিজেপির প্রতিনিধি হিসেবে নয়, প্রাক্তন রাজ্যপাল হিসেবে অনুষ্ঠানে ছিলেন তথাগত রায়। যেমন ছিলেন শ্যামল সেনও। ছিলেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমেরাও।
তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র সুখেন্দু শেখর রায় অবশ্য পাল্টা বলেছেন, ‘‘ওঁরা (বিজেপি) চেয়েছিলেন, এই রাজ্যপালও তাঁর পূর্বসূরির (জগদীপ ধনখড়) মতো রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান, প্রশাসনকে সন্ত্রস্ত করে রাখুন এবং বাংলার নামে কুৎসা করে বেড়ান! কিন্তু দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে আসা আনন্দ বোস সেই পথে না চলায় বিজেপি চূড়ান্ত হতাশ।’’ তৃণমূল সাংসদের প্রশ্ন, ‘‘হাই কোর্টের নির্দেশে নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত করছে কেন্দ্রীয় দুই সংস্থা। সেখানে রাজ্যপালের কি করণীয় আছে? ওঁদের কি আদালতের উপরে আস্থা নেই? নাকি রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলের সঙ্গে পারবে না বুঝে রাজভবনকে নিজেদের দলের কাজে ব্যবহার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন?’’
বিরোধী দলনেতার মতে, রাজ্যপাল বোস যে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাইছেন, সেই উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, রাজ্যপালের ‘ভালমানুষি’কে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে রাজ্য সরকার। নবান্নের ‘দূত’ হিসাবে ‘কাজ’ করছেন রাজ্যপালের প্রিন্সিপাল সচিব নন্দিনী চক্রবর্তী। নন্দীগ্রাম এবং পরে অন্যত্র দু’টি অনুষ্ঠানে গিয়েও এ দিন শুভেন্দু মন্তব্য করেছেন, ‘‘টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। শিক্ষা দফতরটাই পুরো জেলে! যাঁরা শিক্ষা দেবেন, সেই শিক্ষকেরা জাল! মা সরস্বতীকে বলছি, ছেড়ে যেও না। আমরা আবার সব ঠিক করে দেব। ভাল ব্লিচিং দিয়ে সব পরিষ্কার করে দেব!’’ মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন বলেই কি তিনি রাজভবনের অনুষ্ঠানে যাননি? শুভেন্দু বলেন, কেন যাননি, তা তিনি বলেই দিয়েছেন। আর তিনি নন, মুখ্যমন্ত্রীই বরং বিরোধী দলনেতাকে এড়িয়ে চলেন বলে শুভেন্দুর দাবি। এই প্রসঙ্গে হাওড়া স্টেশনে সম্প্রতি ‘বন্দে ভারত’ ট্রেনের উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে না ওঠার প্রসঙ্গ টানেন তিনি।
বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষও কটাক্ষ করেছেন, ‘‘হাতেখড়ি তো বাচ্চাদের হয়। ঠাকুরের সামনে পুরোহিত হাতেখড়ি দেন। এখন হঠাৎ কার, কেন, কার সামনে হাতেখড়ি হচ্ছে, আমি বলতে পারব না। আর প্রথমেই ভুল মাস্টার ধরলে ভুলই শিখতে থাকবেন!’’ দিলীপের অবশ্য রাজভবনে আমন্ত্রণ ছিল না। রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস দিলীপদের পাল্টা বলেছেন, ‘‘রাজ্যপাল যদি বাংলায় এসে বাংলা শিখতে চান, তাতে আপত্তির কী আছে? ওঁরা (দিলীপ) বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি শেখার চেষ্টা করুন, ভুল শোধরান। না হলে ৭০ থেকে সাতে নেমে যাবেন!’’
শিক্ষায় দুর্নীতি এবং হাতেখড়ির অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন তুললেও রাজভবনের আমন্ত্রণ স্বীকার করে সেখানে গিয়েছিলেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘শুভেন্দু কোথায় যাবেন আর কোথায় যাবেন না, তাতে মানুষের কী এসে যায়! মানুষ দেখছেন, বঞ্চিত চাকরি-প্রার্থীরা লুটের শিকার হয়ে রাস্তায় বসে আছেন। তবে তার সঙ্গে রাজভবনের আমন্ত্রণে যাওয়া বা না যাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই।’’ একই সঙ্গে অবশ্য তাঁর কটাক্ষ, ‘‘হয়তো হাতেখড়ি নিয়ে রাজ্যপাল ধন্য। হাতেখড়ি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীও ধন্য!’’ রাজভবনে এ দিন দেখা যায়নি কংগ্রেসের কাউকে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বহরমপুরে ছিলেন দলীয় কর্মসূচিতে। আমন্ত্রিত না হলেও কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘শিক্ষায় দুর্নীতি অবশ্যই গুরুতর বিষয়। কিন্তু তার সঙ্গে ব্যক্তি রাজ্যপালের হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের সম্পর্ক নেই। অন্য রাজ্য থেকে কেউ এসে বাংলা শিখতে চাইলে সেটা বরং ভালই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy