Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

সবাই একসঙ্গে বাঁচতে চায়, কেমন আছ নয়, দেখা হলে প্রশ্ন কত আছে?

এ লড়াই বাঁচার লড়াই! কলকাতা থেকে কোচবিহার, সুন্দরবন থেকে সাগরদিঘি— সবাই একসঙ্গে বাঁচতে চায়। এক অদ্ভুত সাম্যবাদ যেন রাতারাতি মাথা তুলে ডালপালা ছড়িয়েছে। সাধু, অসাধু, মন্ত্রী, বেয়ারা, বাদশা, গোলাম সকলেই নিজের মতো লড়ে যাচ্ছেন।

বদলের অপেক্ষায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে। শুক্রবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

বদলের অপেক্ষায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে। শুক্রবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:১০
Share: Save:

এ লড়াই বাঁচার লড়াই!

কলকাতা থেকে কোচবিহার, সুন্দরবন থেকে সাগরদিঘি— সবাই একসঙ্গে বাঁচতে চায়। এক অদ্ভুত সাম্যবাদ যেন রাতারাতি মাথা তুলে ডালপালা ছড়িয়েছে। সাধু, অসাধু, মন্ত্রী, বেয়ারা, বাদশা, গোলাম সকলেই নিজের মতো লড়ে যাচ্ছেন।

যেটুকু ফারাক তা শুধু পরিকল্পনায়। কেউ রাত জেগে লাইন দিচ্ছেন ব্যাঙ্ক বা এটিএমের সামনে। কেউ আবার নিদ্রাহীন হিসেব কষে চলেছেন লক্ষ-কোটি রক্ষা করার জন্য। আসলে দু’জনকেই বাঁচতে হবে।

পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিল হওয়ার দশ দিন পরেও ‘জীবন সংগ্রামের’ ছবিটা এতটুকু বদলাল না। পরিচিতকে দেখে ‘কেমন আছ’, জানতে চাওয়ার আগে ‘কত আছে?’ জিগ্যেস করার অভ্যাসে ক্রমশ রপ্ত হয়ে উঠেছেন মানুষ। সৌজন্যের এ হেন প্রকাশ নোট-বাতিল পর্বের এক নয়া প্রাপ্তি!

‘কত আছে’ প্রশ্নটা কিন্তু ব্যঞ্জনায় মাখা। বুঝ লোক যে জান সন্ধান!

একেবারে সাধারণ সংসারী মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তেরা প্রতিদিন বারবার পকেট হাতড়ে দেখছেন, ব্যাঙ্ক থেকে পুরনো নোট বদল করে আনা চার হাজারের কতটা পড়ে আছে এবং সেটা দিয়ে আর কত দিন দোকান-বাজার চলবে।

এক বেসরকারি সংস্থার কনিষ্ঠ কেরানি আবার দু’হাজারের নোট পকেটে নিয়ে বহু দোকান চষে ফেলেছেন। বিশ-পঞ্চাশ-একশো টাকার জিনিস কেনার জন্য কেউ তাঁকে টাকা ভাঙিয়ে দেয়নি। তাঁর মাথাব্যথা ছেলের স্কুলের টিফিন, দিনের বাজার, বৌয়ের ওষুধ, নিজের বাসভাড়া। আছে, তবু নেই-এর এই পরিস্থিতি তাঁকে দার্শনিক হতে শেখায়নি। বরং আরও বেশি যুদ্ধের পথে ঠেলে দিয়েছে। তাই শুক্রবার দুপুরে বিবাদি বাগের পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওই যুবকের ঘোষণা, ‘‘আজ এটিএম থেকে একশোর নোট পেতেই হবে।’’

না, এই যুদ্ধ রক্তক্ষয়ী নয়। ব্যাঙ্ক বা এটিএমের দরজায় কেউ কারও মুখ ফাটিয়ে, ল্যাং মেরে লাইন ভেঙে এগোনোর মতো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেনি, অন্তত এখন পর্যন্ত। অপেক্ষার পালাও হয়তো একটু কমেছে। কিন্তু প্রয়োজনের নগদ টাকা সুবিধাজনক নোটে হাতে পাবার জন্য রোজ নিজেদের ধৈর্যের সঙ্গে লড়াই করা? সেটাও তো বড় কম নয়।

পাড়ার মুদিখানা, গড়িয়াহাট, লেক মার্কেটের চেনা মাছওয়ালা, আনাজ বিক্রেতা, এমনকী কাপড় কাচানোর লন্ড্রি-মালিক সবাই অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘বৌদি, ভাববেন না। পুরনো নোট নিয়ে নেব।’’

এক দিন-দু’দিন-পাঁচ দিন যেতে না যেতেই অন্য ছবি। এখন আর কেউ কথা রাখে না! একশো টাকার নোট না দিলে মুদি থেকে মাছওয়ালা সবাই মুখ ফেরাতে চান। অথচ একশোর জোগানেই যে টান। পেটিএম, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে এখনও অনভ্যস্ত বৌদির সংসারেও অতএব যুদ্ধ-যুদ্ধ হাওয়া। নগদ টাকার আকালের মধ্যে নিত্যদিন গৃহস্থালি সামলানোর লড়াই তাঁর। প্রতিপক্ষ কখনও মুদি, কখনও মোদী।

তবু সংসার তো থেমে নেই। দোকানে-বাজারে ধারের খাতা খুলতে হলেও চাকা চলমান। ভাতের পাতে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী মাছ, মুরগি, মটনও জুটে যাচ্ছে! তা হলে লড়াই কার বিরুদ্ধে?

প্রশ্নটা সহজ, উত্তরও জানা। যাঁদের কাছে টাকার প্রয়োজন প্রধানত দৈনন্দিন দোকান-বাজার, লেখাপড়ার খরচ কিংবা ডাক্তার-ওষুধের মতো আবশ্যিক, তাঁরা সবাই বোঝেন, লক্ষ-কোটি বেহিসেবি টাকার পাহাড় চূড়ায় বসে থাকা কিছু লোককে টেনে মাটিতে নামাতে কিছু করা জরুরি ছিল।

সেই কারণেই পাঁচশো-হাজার বাতিলের ঘোষণা হওয়া মাত্র যাঁদের ঘরে সবচেয়ে জোরে ‘বিপদ’ ঘণ্টা বেজেছিল, ‘বাঁচার’ তাড়নায় তাঁরাও পথে নেমে পড়েন ওই রাতেই। তাঁদের জগতের কোণে কোণে দাবানলের মতো বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। মোটা কমিশনের শর্তে বাজারে ছড়িয়ে থাকা ‘অপারেটর’ এবং ‘ম্যানেজারেরা’ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ঘন ঘন ফোন যেতে থাকে— ‘কত আছে? কত?’

একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় রাজ্য জুড়ে নেমে পড়ে সেই অপারেটরদের টিম। দলে দলে ছেলে। কয়েকদিন ধরে যাদের কাজ ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে বাতিল নোট বদলানো, ‘পার্টির’ অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করা ইত্যাদি। তখনও অবশ্য আঙুলে কালির দাওয়াই চালু হয়নি।

টাকা বাতিলের রাতেই সারা দেশের সঙ্গে এই শহরের বেশ কয়েকটি গয়নার দোকান আবার পাঁচশো-হাজারের নোট সোনা এবং হীরেতে বদলে দেওয়ার ব্যবসা খুলে দিয়েছিল। বড়বাজারে তো বটেই, কলকাতার আরও কিছু এলাকায় সোনা-হীরে কেনার সেই ধুম চলে একটানা প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। সবটাই গোপনে। কালো টাকার সেই লেনদেনে সোনার দাম নিমেষে দেড় গুণ বেড়ে যায়।

ছকটা হল, এখন কালো টাকায় সোনার বিস্কুট বা হীরের অলঙ্কার কিনে রাখা। পরে সময় বুঝে বিক্রেতার কাছেই তা আবার বেচে দেওয়া। বরাত জোরে বেশি দাম পেলে তো পোয়া বারো, না পেলেও কালো টাকার সিংহভাগটাই সাদা হয়ে যাওয়া নাকি এক রকম নিশ্চিত। এরই পাশাপাশি চড়া দামে বিদেশি মুদ্রা কেনার ব্যবসাও ওই রাতে রমরমিয়ে ওঠে। শুরু হয়ে যায় ‘রুক্কা’। অর্থাৎ চিরকুটে সাঙ্কেতিক অঙ্ক লিখে মোটা কমিশনে টাকা পাচার। ঘুমিয়ে থাকা কোম্পানির আয়কর ফাইলে টাকা ঢুকিয়ে সেই টাকা ঘুরপথে বের করে নেওয়ার পরিচিত পথ তো আছেই।

চোরাপথে অবৈধ টাকা বাঁচানোর এই সব লড়াই যাঁরা লড়েন, তাঁরা হয়তো আমাদের চেনা, হয়তো অচেনা। কারণ এঁদের অনেকেরই পরিচিত মুখের আড়ালে অপরিচিত অন্য একটি মুখ রয়েছে। এঁদের কে পেশাদার, কে বড় চাকুরে, কে রাজনীতিক, কে অন্য কেউ— সে সব প্রশ্ন অবান্তর। যা প্রাসঙ্গিক তা হল, তাঁরাও আমাদের সঙ্গে একই সমাজে বাস করেন। এবং আক্ষরিক অর্থেই তাঁরাও বাঁচার লড়াই লড়ছেন!

নোট বাতিল ঘোষণার রাতে গরম মাংসের ঝোলে ফুলকো লুচি ডুবিয়ে খেতে খেতে এক জাঁদরেল নেতা অবশ্য বলেছিলেন, ‘‘যারা সত্যিই টাকা করে, তারা সেটা বাঁচাতেও জানে। ফালতু টেনশন করে না।’’

‘বেটি বাঁচাও’-এর দেশে এখন ‘কোটি বাঁচাও’! বেটি যদিও বা না-বাঁচে, ‘কোটি’ কি সহজে মরে?

অন্য বিষয়গুলি:

demonetization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy