Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Drinking Water Crisis in Siliguri

শিলিগুড়ির জলসমস্যা: দূষণ কোথা হইতে আসিয়াছ? তিস্তা নদী, গজলডোবার বাঁধ এবং মহানন্দার স্রোত হইতে!

গত কয়েক দিন ধরে পানীয় জলের সঙ্কটে শিলিগুড়ি। বুধবার মেয়র ঘোষণা করেছেন, পুরসভার জল আপাতত পানের অযোগ্য। তার পর থেকেই পানীয় জলের হাহাকার শুরু হয়েছে শহর জুড়ে। শুরু হয়েছে জলের কালোবাজারি।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পার্থপ্রতিম দাস
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৪ ১৬:৪৭
Share: Save:

পানীয় জলের হাহাকার দেখা দিয়েছে শিলিগুড়িতে। স্বয়ং মেয়র গৌতম দেব ঘোষণা করেছেন, পুরসভার সরবরাহ করা জল নিরাপদ নয়। সেই জল দূষিত। তাই আপাতত কয়েক দিন ওই জল পান করা যাবে না! শিলিগুড়ির জলের এই দূষণের উৎস কী? ‘কোথা হইতে আসিয়াছে’ দূষণ?

সাধারণত, তিস্তার জল পরিস্রুত করে শিলিগুড়িতে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু গত অক্টোবরে তিস্তার হড়পা বানে যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল উত্তরবঙ্গে, তাতে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গজলডোবায় তিস্তার নদীবাঁধ। সেখানেই গোলমালের সূত্রপাত।

বর্ষা আসার আগে জরুরি ভিত্তিতে গজলডোবার বাঁধ সারিয়ে তোলা প্রয়োজন। যার জন্য অন্তত ১৫ থেকে ২০ দিন তিস্তার জল সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে শিলিগুড়ি পুরসভাকে। বিকল্প হিসাবে উঠে এসেছে মহানন্দা নদীর নাম। পুরসভা সিদ্ধান্ত নেয়, মহানন্দার জল পরিস্রুত করে আপাতত কয়েক দিন শহরে বণ্টন করা হবে।

শিলিগুড়ি পুরসভার সামনে বিক্ষোভ।

শিলিগুড়ি পুরসভার সামনে বিক্ষোভ। —নিজস্ব চিত্র।

কিন্তু মহানন্দার জলের শুদ্ধতা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন রয়েছে। বাম আমল থেকেই মহানন্দার জল তিস্তার বিকল্প হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল। বার বার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মেয়র নিজেও মেনে নিয়েছেন, মহানন্দা নদীর গভীরতা কম। ফলে ওই জল তিস্তার মতো শুদ্ধ নয়। তা সত্ত্বেও আপাতত কিছু দিনের জন্য ওই জল পরিস্রুত করে শহরে সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেয় শিলিগুড়ি পুরসভা। বিতর্কের জন্ম সেখানেই। পুরসভা থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, মহানন্দার জল আপাতত নিরাপদ। তা পরিশুদ্ধ করে শহরে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু বুধবার পুরসভার কাছে সেই জলের রিপোর্ট আসে। সেখানে দেখা যায়, মহানন্দার জলে বিওডি-র (বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড) মাত্রা অত্যন্ত বেশি। তাই ওই জল খাওয়ার যোগ্য নয়। এই জল খেলে ডায়েরিয়া, ত্বকের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

রিপোর্ট হাতে পেয়ে তড়িঘড়ি পানীয় জলে নিষেধাজ্ঞা জারি করার সিদ্ধান্ত নেয় শিলিগুড়ি পুরসভা। যদিও অন্য কাজে ওই জল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা নেই। বিকল্প হিসাবে শহরে পানীয় জলের পাউচ বিলি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জলের এই সঙ্কটে রাতারাতি উত্তাল হয়ে ওঠে শিলিগুড়ি। বৃহস্পতিবার পুরসভার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে পথে নেমেছে বামেরা। বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে মেয়রের গাড়ি আটকে। তাঁর বিরুদ্ধে ‘চোর চোর’ স্লোগানও দেওয়া হয়েছে।

জলসঙ্কটে শিলিগুড়ি পুরসভার সামনে বিক্ষোভ অশোক ভট্টাচার্যদের।

জলসঙ্কটে শিলিগুড়ি পুরসভার সামনে বিক্ষোভ অশোক ভট্টাচার্যদের। —নিজস্ব চিত্র।

সাধারণত, শিলিগুড়ি থেকে জলের নমুনা কলকাতায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে জলের মান পরীক্ষার পর রিপোর্ট যায় শিলিগুড়িতে। এ ক্ষেত্রেও সেই পদ্ধতিই মানা হয়েছে। শিলিগুড়ির মানুষের প্রশ্ন, রিপোর্ট পাওয়ার আগেই কী করে মহানন্দার জল নিরাপদ বলে ঘোষণা করা হল এবং কী ভাবে সেই জল শহরে সরবরাহ করা হল? তা হলে কি এত দিন বিষাক্ত জলই খেলেন সকলে? বিরোধীদের অভিযোগ, ১৫-২০ দিন ধরে শিলিগুড়ির মানুষকে বিষাক্ত জল খাইয়েছে পুরসভা। মেয়রকে অযোগ্য বলে কটাক্ষ করেছেন বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। পুরসভার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন প্রাক্তন মেয়র তথা সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যও। বিরোধীদের অভিযোগ অবশ্য মানতে রাজি নন মেয়র। গৌতম বলেন, ‘‘জলের বিওডি মাত্রা ঠিক থাকায় সেই জল সরবরাহ করা হচ্ছিল। যে মুহূর্তে আমরা জানতে পেরেছি, বিওডি মাত্রা সঠিক নেই, সেই মুহূর্তে জল খেতে বারণ করেছি। মহানন্দার জলে প্রথম থেকেই একটা বড় সমস্যা জলস্তর। এই মুহূর্তে তা ঠিকই রয়েছে। আমরা জলের বিওডি লেভেল পরীক্ষা করেছিলাম। সঠিক থাকায় ওই জল সরবরাহ করেছি। এখন জানা গিয়েছে, ওই জল পানের যোগ্য নয়। পুরনিগমের নিজস্ব জলের ট্যাঙ্ক, পাউচের বন্দোবস্ত করে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা চলছে। শীঘ্রই এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা আশাবাদী।’’

শিলিগুড়ি শহরে পানীয় জলের লাইন।

শিলিগুড়ি শহরে পানীয় জলের লাইন। —নিজস্ব চিত্র।

প্রাক্তন মেয়র অশোক অবশ্য এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেছেন মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যান্টে দুর্নীতিকে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মহানন্দার জলকে পরিস্রুত করে সরবরাহের কথা মেয়র বলছেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ, জলের বিওডি লেভেল পরীক্ষা করতে অন্তত পাঁচ থেকে ছ’দিন লাগে। তা হলে বিগত কয়েক দিন ধরে যে জল সরবরাহ করা হচ্ছিল, তা রিপোর্টবিহীন। বহু মানুষ ওই জল খেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বাম আমলে মহানন্দার জলকে ব্যবহার করার জন্য এবং নদীকে বাঁচানোর জন্য মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যান্টের মতো প্রকল্পের অনুমতি দিল্লি থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। যার প্রথম পর্যায়ে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। তার পর রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। সেই ২০০ কোটি টাকার সঠিক কোনও হিসাব না পাওয়ায় কেন্দ্র থেকে টাকা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যান্টও বন্ধ হয়ে যায়। ওই প্রকল্পের টাকায় দুর্নীতি হয়েছে। তা সঠিক ভাবে কাজে লাগানো হলে এই দিন দেখতে হত না।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy