Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

আশ্বিনের হাওয়ায় তুলাইপাঞ্জির গন্ধ, মালতীর অবাক চোখ

চুপ করে পণ্ডিতমশায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাঁর আসনের সামনে রেখেছিলাম আমার পুজোর ডালি। মা যেমন যেমন বলেছিল, তেমন তেমনই করেছি। তিনি অসুস্থ। প্রতিবার তিনিই পুজোর আয়োজন করে দেন। এ বার আমার দায়িত্ব।

চিত্রণ: শেখর রায়

চিত্রণ: শেখর রায়

শ্যামশ্রী দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০২:০৭
Share: Save:

সন্নতাঙ্গী। মানে জানিস?

চুপ করে পণ্ডিতমশায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাঁর আসনের সামনে রেখেছিলাম আমার পুজোর ডালি। মা যেমন যেমন বলেছিল, তেমন তেমনই করেছি। তিনি অসুস্থ। প্রতিবার তিনিই পুজোর আয়োজন করে দেন। এ বার আমার দায়িত্ব। ভয়ে বুক কাঁপছে। কোথায় কোনও ভুল করেছি কি না জানি না। পণ্ডিতমশায়ের কথা শুনে ওই ঝুঁকেই স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

পণ্ডিতমশায় হেসে বললেন, ‘‘দুর্গার এক নাম। যুদ্ধ করার সময় তিনি একবার ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই ঝুঁকে দাঁড়ানোর মুহূর্তে শিব তাঁকে আদর করে এই নামে ডাকেন।’’

শিব, উমা আর পুজো, সবই ঘুরে ঘুরে এসেছে জীবনে। যেমন সকলের আসে। কিন্তু পুজোকে অনেক বারই সময় দিতে পারিনি। চাকরি করি সংবাদ মাধ্যমে। কোথায় না কোথায় ঘুরতে হয়েছে! পুজোর সময়ও ছুটি পাইনি কতবার। একবার পুজোর মধ্যে চলে যেতে হল দার্জিলিং। একজন সেলিব্রিটি গিয়েছেন, কভার করতে হবে। মেঘ মায়ার মধ্যেই পুজো কেটেছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেলাম না একদিনও। এক বার যেতে হল ডুয়ার্সে। সেখানে তখন ভয়ঙ্কর বন্যা। পুজো কোথায়? চোখের সামনে তিস্তা-করলা গিলে ফেলেছে কত জনের ঘরকন্না। মা-বউ-মেয়েকে বাঁচাতে ছুটছে মানুষ। মৃন্ময়ী মুখের গর্জন তেল ধুয়ে যাচ্ছে জলে। আমি ছুটছি বাইট নিতে। ছবি পাঠাতে হবে।

দীর্ঘ সংসারযাত্রায় বাড়ি সামলে, বর সামলে, ছেলে সামলে ছুটতে হয়েছে সংবাদের সংসার সামলাতে। কোনও কোনও সহকর্মী হেসে বলেছে, ‘‘তুমিও দুর্গার মতো। দশভুজা।’’

যত বার এই কথাটা শুনি, ততবার পণ্ডিতমশায়ের কথাটা মনে পড়ে।

যুদ্ধ। যুদ্ধ। যুদ্ধ। সারাটা জীবন ধরেই যুদ্ধ। তার ফাঁকেই পুজো আসে। সেই ছোটবেলা থেকে রেডিওর নব ঘুরিয়ে মহিষাসুরমর্দিনীর সদর্প আর সুরেলা উপস্থিতি বোঝার অনেক আগে থেকেই বেশ টের পাওয়া যেত পুজো আসছে। বৃষ্টি থামলেই কৈশোরের মেঘেরা জানান দিত। রঙ বদলে যেত চারপাশের। গুটি গুটি পায়ে কখন যেন ঢুকে পড়ত শরৎ।

মহালয়া যখন শুরু হতো, তখন ভোরের বাতাসে হিমহিম ভাব। ঘুম চোখে রেডিওয় কান পাতার ফাঁকেই চলত চেনা চাদরে ওম খুঁজে নেওয়া। গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে থাকতো শিউলির গন্ধে। খাস শহরেও ইতিউতি শিউলি গাছ। সাদা-কমলায় মাখামাখি জলছবির সঙ্গে পরিচিত গন্ধটাই সেই ধূসর ভোরে বাইরে টানতো। পুজোর ঘর থেকে ভেসে আসতো শাঁখের আওয়াজ। দেবীকে আবাহন করতেন মা আর ঠাকুরমা।

পাড়ার মাঠে যেখানে মণ্ডপের জন্য বাঁশ বাধা, তারই এক কোণে স্কুল-কলেজ-অফিস ছুটির ফাঁকে ছোট বড় গোল। কারা যাবে ঠাকুর আনতে, কে সামলাবে ভোগের ভাঁড়ার, বড়দের এমনি নানা ভাবনায় সরগরম। সেখানে হাজির থেকেও সামিল হতে না পারার যন্ত্রণাটা কাঁটার মতো বিঁধতো।

বাবা তখন কর্মসূত্রে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে। মহালয়ার ভোর মানেই দিনগোনা শুরু। বাবার বাড়ি ফেরার। পঞ্চমীর রাতটা বরাবরই ছিল দীর্ঘ। ষষ্ঠীর ভোরে বোধনের ঢাকে কাঠি পড়ত যখন, চোখ থাকতো বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ি পর্যন্ত লম্বা রাস্তাটায়। বাবার আনা তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত ফুটতে শুরু করলেই উৎসবের গন্ধে ম ম করতো গোটা বাড়ি। মণ্ডপে অষ্টমীর ভোগ বাদ দিলে পুজোর ক’দিন দুপুরের ভূরিভোজ ছিল বাড়িতেই। দেশ-বিদেশকে মিলিয়ে দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অবকাশ হয়তো ছিল না, কিন্তু মায়ের হাতের গুণে আলাদা ভাবে চিহ্নিত হয়ে যেত পুজোর মেনু।

পুজোর ফ্যাশন থাকলেও আমাদের শব্দবন্ধে তখনও ছিল না শপিং মল। ছুটির দুপুরে পুজোর বাজার করতে যাওয়া হতো কাছের মার্কেটে। নেহাতই ছোট তখন। টিপ টিপ ববি প্রিন্টের রমরমা ঘাঁই মারে স্মৃতিতে। পরে পরে প্যারালাল-ম্যাক্সি-মিডি-সালোয়ার-জিন্সের স্টাইল স্টেটমেন্ট। মালতীকে মনে পড়ে। প্রায় সমবয়সী মালতী আসত তার মায়ের হাত ধরে। সপ্তমীর দুপুরে ঘর মোছার ফাঁকে কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত খাট জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নতুন পোশাকগুলির দিকে। গর্ব হয়েছিল খুব। মালতীর নামিয়ে নেওয়া চোখ দেখেও কোনও কষ্ট টের পাইনি সে দিন।

সময় বদলে যায়। পরে এমনই অনেক মালতীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, বারবার। কখনও তিস্তার পাড়ে ঘর-সংসার হারিয়ে। কখনও বা অন্য কোথাও। ছোটবেলার কথা মনে পড়েছে। চোখ তুলে তাকাতে পারিনি তাদের চোখে। সংবাদ সংগ্রহের কাজটা সেরে নিয়েছি কোনও ক্রমে। সহকর্মীর দেওয়া দশভুজা নাম তখন ব্যঙ্গ করেছে শুধু।

কত কত বছর পার হয়ে গেল।

এখনও সংসার সীমান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছি। একটু ঝুঁকে।

অন্য বিষয়গুলি:

durga puja ashwin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy