আক্রান্ত: গণপিটুনির শিকার হন এই যুবকই। ফাইল চিত্র
হঠাৎ এত গণপিটুনি কেন—এই প্রশ্নেই তোলপাড় উত্তর দিনাজপুর জেলা।
কপালে ভাঁজ পড়েছে প্রশাসনের। ঘুম ছুটেছে পুলিশের। ‘দয়া করে গুজবে কান দেবেন না’, পাড়ায় পাড়ায় মাইক ফুঁকে প্রচার করছে তারা। পঞ্চায়েত প্রধান বৈঠক করছেন ইমাম ও বাছাই করা নাগরিকদের নিয়ে। কিন্তু কী ভাবে এই রোগের মোকাবিলা করা যাবে, তার কোনও হদিস এখনও মেলেনি, জানাচ্ছে প্রশাসনেরই একাংশ। ইসলামপুর পুলিশের কেউ কেউ বলছেন, যে গুজবে এত দিন ডুয়ার্সে পরের পর গণপ্রহারের ঘটনা ঘটেছে, সেটাই ছড়াচ্ছে এই এলাকাতেও। গত ১৫ দিনে ১৪টি প্রহারের ঘটনাই এর প্রমাণ। প্রায় সব ক’টির পিছনে রয়েছে ছেলেধরা গুজব। কিন্তু কী ভাবে এই গুজব সামলানো যাবে, কেউ বলতে পারছে না।
বাসিন্দাদের বক্তব্য, এর পিছনে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব যথেষ্টই। সেখানেই ছড়িয়েছে যে, এলাকায় হানা দিচ্ছে ছেলেধরার দল। কিন্তু এটা কারা করছে, কেনই বা করছে— স্পষ্ট জবাব নেই পুলিশ-প্রশাসনের কাছে। জেলা পুলিশকর্তাদের দাবি, ‘‘প্রতিটা ঘটনায় পুলিশ গিয়ে দ্রুত আক্রান্তদের উদ্ধার করা হয়েছে। গুজব ছড়ানোর পিছনে কোনও বহিরাগত চক্র কাজ করছে বলেই আমাদের ধারণা। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নজর রাখা হচ্ছে।’’
পিটুনির ইতিবৃত্ত
৩ সেপ্টেম্বর: ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে মারধর ইসলামপুরে
৪ সেপ্টেম্বর: পথ ভুলে করা এক দম্পতিকে মার ইসলামপুরের রামগঞ্জে
৬ সেপ্টেম্বর: গোয়ালপোখরের পাঞ্জিপাড়ায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাকে মারধর
৭ সেপ্টেম্বর: ছেলেধরা সন্দেহে দুই ফেরিওয়ালাকে মার রামগঞ্জে। তিন জনকে মার ডালখোলায়। ইসলামপুরে এক যুবককে মার
৮ সেপ্টেম্বর: ইসলামপুরের মিলনপল্লিতে এলাকায় এক যুবককে বাঁচালেন বাসিন্দারাই
১০ সেপ্টেম্বর: চোপড়া মাঝিয়ালি এলাকায় এক যুবককে মারধর
১২ সেপ্টেম্বর: চাকুলিয়া তেলিয়াপোখরে মানসিক ভারসাম্যহীনকে মার। ভাড়না গ্রামে এক ফেরিওয়ালাকে মার
১৪ সেপ্টেম্বর: চাকুলিয়ার রামপুরে এক মানসিক ভারসাম্যহীনকে মার। বিহার সীমানার পুঠিয়া গ্রামে এক যুবককে মার
গত বছরেও একই ভাবে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় গুজবের জেরে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে এক দিকে ছিল জলপাইগুড়ি জেলা, অন্য দিকে মালদহ। এ বারে কিন্তু কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি জেলা হয়ে শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে মারধরের ঘটনা ঢুকেছে উত্তর দিনাজপুরে। যে কথা উল্লেখ করে পুলিশমহলেরই একটা বড় অংশ বলছে, এর পিছনে কোনও ছকও থাকতে পারে। তবে তাঁরা আশঙ্কা করছেন, গুজবের জাল শীঘ্রই দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহে ছড়াবে।
গুজবের ধাক্কা হয়েছে মারাত্মক। সন্তানদের এখনই আর সন্ধ্যার পরে একা ছাড়তে চাইছেন না অভিভাবকেরা। স্কুলগুলিতে এখনই হাজিরা সে ভাবে না কমলেও বাবা-মায়েরা ভয় পাচ্ছেন। ফলে অদূর ভবিষ্যতে গুজবের প্রভাব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রশাসনের।
অনেকেরই ধারণা, গুজবকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের ব্যক্তিগত শত্রুদের নিশানা করতে পারে। সুপরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে এবং মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে কাজে লাগিয়ে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। তার প্রভাব পড়ছে ঘরে ঘরে।
চাকুলিয়ার এক অভিভাবক বলেন, ‘‘ছেলেধরা বেরিয়েছে, এমন কথা শোনার পর থেকে মেয়েকে স্কুলে পাঠাচ্ছি না।’’ গোয়ালপোখরের সামিম আখতারের অবস্থাও এক। সন্তানকে এখনই তিনি চোখে চোখে রাখতে শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘সবাই বলছে ছেলেধরা বেরিয়েছে। সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে সন্তানকে নিয়ে কোনও ঝুঁকি নেব না।’’
গুজবের মাহাত্ম্য এতটাই যে, গত পনেরো দিন ধরে ইসলামপুর, চোপড়া এবং চাকুলিয়া এলাকায় বাসিন্দারা পালা করে রাত পাহারায় নেমেছেন। আর সেটাই উদ্বেগ বাড়িয়েছে প্রশাসনের। জেলা পুলিশের দাবি, গুজব এমনই দাওয়াইহীন এক রোগ। এর বিকল্প একটাই, সচেতনতা। উত্তর দিনাজপুর জেলা পুলিশ সুপার কার্তিকচন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরা নিয়মিত গুজবের বিরুদ্ধে প্রচার ও সচেতনতা শিবির করছি। আদতে এর কোনও সমাধান নেই। তবে গুজবে কান না দেওয়াটাই সমাধান।’’ ইসলামপুর জেলা পুলিশ সুপার সচিন মক্কার বলেন, ‘‘ছেলেধরা গুজব ঘিরে বিভিন্ন জায়গায় বিভ্রান্তি চলছে। পুলিশকে আরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছেও আবেদন করা হচ্ছে, কোনও খবর কানে এলে আগে পুলিশকে জানান। পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy