Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
অশ্রুকুমার সিকদার প্রয়াত, শোকে ভাষাহীন উত্তরবঙ্গের মানুষ

নিজের লেখাই যেন নতুন করে পড়লাম

আমরা যারা গত শতকের সাতের দশক থেকে লেখালিখির জগতে সামান্য পরিচিত হতে শুরু করেছি, অশ্রুকুমার সিকদার তাদের অগোচরেই তাদের উপরে নজর রাখতে শুরু করেছিলেন।

শেষযাত্রা: বোনের বাড়ির সামনে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

শেষযাত্রা: বোনের বাড়ির সামনে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

অভিজিৎ সেন 
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৫:২৩
Share: Save:

আমরা যারা গত শতকের সাতের দশক থেকে লেখালিখির জগতে সামান্য পরিচিত হতে শুরু করেছি, অশ্রুকুমার সিকদার তাদের অগোচরেই তাদের উপরে নজর রাখতে শুরু করেছিলেন। তার খবর আমরা অনেকেই রাখতাম না। এর কারণ সম্ভবত ওই দশকের রাজনৈতিক আন্দোলন। সমর সেন মশাই ‘বাবু বৃত্তান্ত’ লিখেছিলেন নকশাল আন্দোলনের ফলে। আর কিছু না হোক, তাকের উপরে সাজানো জিনিসপত্র আর আগের জায়গায় ছিল না, এরকম একটা কথা। সে কারণেই বোধহয় সাতের দশকের লেখার একটা গুণগত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। সাতের দশকের লেখার একটা গুণগত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।

আটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অশ্রুবাবুর বাড়িতে যাই। অশ্রুবাবু সাদরে আমাকে গ্রহণ করেছিলেন। এত দিন পরেও বেশ মনে রয়েছে, দীর্ঘ ক্ষণ ধরে তিনি আমার লেখক জীবনের সেই আদিপর্বের লেখাগুলো নিয়ে তিনি কত মন দিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তীক্ষ্ণ মেধা। মনে হচ্ছিল যেন আমার নিজের লেখাই যথার্থ অধ্যাপকের মতো আমাকেই পড়াচ্ছেন। খুব আপ্লুত হয়ে ফিরে এসেছিলাম। হঠাৎ এই উন্মোচনে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল।

তার পর যতবার শিলিগুড়ি যাওয়া হয়েছে, প্রতিবারই তাঁর বাড়িতে যাওয়া। এ ধরনের গভীর সম্পর্ক শুধু আমার সঙ্গে নয়। সাতের দশকের লেখকদের অনেকের সঙ্গেই অশ্রুদার এমন সম্পর্ক ছিল। স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অমর মিত্র, ভগীরথ মিশ্র, শচীন দাস, প্রতিক্ষণ পত্রিকার যাবতীয় তরুণ, তরুণতর লেখকদের অকুণ্ঠ উৎসাহ দিতে তিনি মুক্তমন ছিলেন সর্বদাই।

আমার উত্তরবঙ্গ থাকাকালীন প্রায় পুরো সময়টাই অশ্রুদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বিগত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমার শিলিগুড়ি যাওয়া কমে গেল। অশ্রুদার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া কম হতে শুরু করল। মাঝেমধ্যে টেলিফোনে কথা হত। অবশেষে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে কলকাতায় বাসা নিলাম। সৌভাগ্যক্রমে অশ্রুদার সঙ্গে প্রায় নিয়মিতই যোগাযোগের একটা সুযোগ আশ্চর্য ভাবে ঘটে গেল। দমদমে আমি যেখানে ফ্ল্যাট নিয়েছি, তার কাছাকাছিই তাঁর বড় মেয়ের ফ্ল্যাট। অশ্রুদা সেখানে এলে আমাদের একটা যোগাযোগের সুযোগ হত।

ইতিমধ্যে তাঁর ‘ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য’ বইটি বেরিয়েছে। তাঁর লেখালেখির মধ্যে এই বইখানা এবং ‘এক্ষণ’ সম্পাদনার ব্যাপারে আমি আগ্রহী ছিলাম সব থেকে বেশি। ‘এক্ষণ’-এর একটিতে আমার উপন্যাস ‘বর্গক্ষেত্র’ অবং অন্য একটিতে ‘মাটির বাড়ি’ ছিল। সংকলনে এ দু’টির কোনটি তিনি রাখবেন, সে নিয়ে মতামত চেয়েছিলেন আমার। ‘ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য’ বইটিতে আমার একখানা উপন্যাস থেকে প্রায় দেড়-দু’পৃষ্ঠা উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন তিনি। স্নেহ নয়। তিনি মনে করেছিলেন দেওয়া উচিত, তাই দিয়েছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় আমার লেখা গুরুত্ব পেয়েছে, এ আমার খুব বড় গর্ব।

আমার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ অন্তরঙ্গতা, স্নেহ ও সাহিত্য আলোচনার যে স্মৃতি, তা কি আমার লেখার মধ্যেও পড়েনি?

শেষে তাঁর দীর্ঘ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে আমাদের যোগাযোগ ছেদ পড়ে যায়। দেখতে পেতেন না, সে খবর শুনে কষ্ট হয়েছে। এমন একজন অধ্যাপক কী করে বই না পড়ে রয়েছেন, ভাবতে গিয়ে চমকে উঠেছি তাঁর বেদনায়।

আজ অশ্রুদার প্রয়াণের খবর খুব আকস্মিক কিছু না। কিন্তু শূন্যতা তো বটেই। আমাদের প্রজন্মের সব লেখকের কাছেই প্রিয় ছিলেন, বাংলা সাহিত্যের একজন যথার্থ অভিভাবকের কর্তব্য এই জ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক নিষ্ঠাভরে পালন করেছেন।

(লেখক সাহাত্যিক)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Asru Kumar Sikdar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy