Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Uttarkashi Tunnel Collapse

বাইরে থেকে মুড়ি পাঠানো হত, সুড়ঙ্গে ঢুকতে ঢুকতে সব গুঁড়ো! উত্তরকাশীর অভিজ্ঞতা মানিকের মুখে

কোচবিহারের বাসিন্দা মানিক তালুকদার শুক্রবার দিল্লি থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছেন। সেখানেই তাঁকে সংবর্ধনা দেন উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার চেয়ারম্যান পার্থপ্রতিম রায়।

Manik Talukdar

উত্তরকাশী থেকে উত্তরবঙ্গে পৌঁছে মানিক তালুকদার। —নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কোচবিহার শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:১১
Share: Save:

১৬ দিন আটকে ছিলেন সুড়ঙ্গে। বাড়ির লোকজন ছিলেন মানসিক চাপে। স্ত্রী এমন অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। অবশেষে বাড়ি ফিরছেন কোচবিহারের সেই পরিযায়ী শ্রমিক মানিক তালুকদার। শোনালেন সুড়ঙ্গের অভিজ্ঞতার কথা। জানালেন, কী ভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু, এক মুহূর্তও বাড়ি ফেরার আশা ছাড়েননি।

গত ১২ নভেম্বর উত্তরকাশী জেলার ব্রহ্মতাল-যমুনোত্রী জাতীয় সড়কের উপর সিল্কিয়ারা এবং ডন্ডালহগাঁওয়ের মধ্যে নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গের একাংশ ধসে পড়ে। সাড়ে আট মিটার উঁচু এবং প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ ভাঙা সুড়ঙ্গে আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে তিন জন বাংলার শ্রমিক ছিলেন। দু’জন হুগলির এবং এক জন উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের বাসিন্দা। সেই কোচবিহারের তুফানগঞ্জের বলরামপুরের বাসিন্দা মানিক শুক্রবার দিল্লি থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছেন শুক্রবার দুপুরে। সেখানেই তাঁকে সংবর্ধনা দেন উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার চেয়ারম্যান পার্থপ্রতিম রায়। সঙ্গে ছিলেন বলরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান-সহ গ্রামের সাধারণ মানুষ। গ্রামের ‘হিরো’কে তাঁরা নিয়ে যেতে এসেছেন। তাঁকে ঘিরে এত জন মানুষ। দেখে খানিক বিচলিত হলেন। তবে সবাই যখন উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে ছেঁকে ধরেছেন, মানিক আর কাউকে নিরাশ করলেন না। মুখে চওড়া হাসি টেনে সুড়ঙ্গের ভিতরের প্রতিটি প্রহরের গল্প শোনালেন তিনি। বোঝালেন, যেন কিছুই ঘটেনি। যেন এটাই তাঁদের জীবন। এই রকম ঘটনার জন্য মানিকেরা সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। জীবনের বাজি রেখে কাজ করতে হয় তাঁদের। আবার এ রাজ্যে যাতে কাজ পান, তার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন মানিক।

মানিকের কথায়, ‘‘প্রথম দিকে বুঝেই উঠতে পারিনি যে, টানেলের কোনও অংশ ভেঙে পড়েছে। এক সহকর্মী এসে আমাকে খবর দেয়, ‘দাদা জলদি উঠো, ফেজ় গির গয়া’ (টানেলের অন্য প্রান্ত ধসে পড়েছে)। সঙ্গে সঙ্গে ওয়াকিটকির মাধ্যমে আধিকারিকদের জানালাম ধসের কথা। কিন্তু কোথায় যে ধসেছে সেটা তখনও স্পষ্ট ছিল না। যাঁদের খবর দিচ্ছি, তাঁরাও বুঝতে পারেননি কোথায় ধস নেমেছে। পরে জানতে পারলাম, ২১০ এবং ১৮০ নম্বর ফেজ়ে ধস নেমেছে। প্রায় ২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলে আমরা ৪১ জন শ্রমিক আটকে গিয়েছিলাম।’’ মানিক জানান, তাঁরা কিন্তু ওই ঘটনায় ভয় পাননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা যে চ্যালেঞ্জের মধ্যে কাজ করি, তাতে এই রকমের ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে প্রথম অবস্থায় খানিকটা অসুবিধা হয়েছে। প্রায় ১৮ ঘণ্টা সঠিক ভাবে অক্সিজেন পাইনি। আমরা যেখানে আটকে পড়েছিলাম, তার আয়তন প্রায় ২ কিলোমিটারের মতো ছিল। তাই একটু অসুবিধা হয়েছিল। সকলেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করেছি প্রথম অবস্থায়। তার পর যখন টানেলে অক্সিজেন পৌঁছল, তখন আর কোনও চিন্তা নেই। তখন সকলেই প্রায় নিশ্চিন্ত হয়ে যাই যে, অক্সিজেন পৌঁছে গিয়েছে। শুকনো খাবারও আসছে। কাজেই বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট রসদ রয়েছে।’’

মানিক জানান, উত্তরকাশীর নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গে আটকে পড়ে প্রথম ১০ দিন তাঁরা মুড়ি খেয়ে কাটিয়েছেন। তা-ও আবার গুঁড়ো অবস্থায়। বাইরে থেকে খাবার পাঠানো হচ্ছিল। কিন্তু সিংহভাগ খাবারই হাওয়ায় গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। তবে কখনও তাঁরা আশাহত হননি। মানিকের কথায়, ‘‘আমরা বেঁচে ফিরব, এই আশা সব সময়েই ছিল। তবে সুড়ঙ্গে ভেতরের কয়েক দিন নানা জনের নানা রকম কাণ্ডকারখানা ছিল। কেউ কয়েক দিন শুধুই শরীরচর্চা করেছেন। কেউ মাটিতেই লুডোর ছক কেটে সুড়ঙ্গের পাথর দিয়েই ঘুঁটি বানিয়ে লুডো খেলেছে। আবার অনেকেই দল বেঁধে ২ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ জুড়ে শুধু চোর-পুলিশ খেলছে।’’ বলতে বলতে হেসে ফেলেন মানিক। তিনি আবারও বলেন, ‘‘একেবারে বাচ্চাদের মতো হাবভাব। মনোবল চাঙ্গা রাখতে সকলেই নানা রকম কাণ্ডকারখানা করছে।’’ তবে মানিক বিশ্বাস করেন, তাঁদের থেকে বেশি কষ্ট করেছেন, যাঁরা সুড়ঙ্গের বাইরে ছিলেন এবং যাঁরা প্রতি দিন, প্রত্যেক মুহূর্তে তাঁদের পাশে থেকেছেন এবং বাইরে বার করে আনার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

মানিকের স্ত্রী বলেছেন, স্বামীকে আর কখনও ভিন্‌রাজ্যে এমন ঝুঁকির কাজ করতে দেবেন না। মানিকের কী বক্তব্য? প্রৌঢ়ের কথায়, ‘‘রাজ্যে যদি সঠিক মাইনে বা কাজ থাকত, তা হলে তো আর বাইরে গিয়ে এ ভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মজদুরি করতে হয় না! আমার স্ত্রী হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত। ছেলে বিএ পাশ করে বসে রয়েছে। সংসার তো চালাতে হবে। রাজ্যের কাছে আগেও আবেদন জানিয়েছি, এখনও আবেদন জানাচ্ছি— বিভিন্ন লগ্নিকারী সংস্থা বা কোম্পানিদের রাজ্যে নিয়ে এসে এখানেই আমাদের মতো মানুষদের কাজের বন্দোবস্ত করা হোক।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy