অনুপ্রেরণা: চাকুলিয়া হাইস্কুলে সাহার বানু। নিজস্ব চিত্র
এক দিকে চরম অনটন, অন্য দিকে দুর্ঘটনায় ঝলসে যাওয়া শরীর। শুধুমাত্র পড়ার টানে কিশোরী বয়সে রুখে দিয়েছিলেন নিজের বিয়ে। লেখাপড়া নিয়ে ‘মেয়ে-মানুষের’ এত জেদ দেখে উঠতে বসতে সঙ্গী হয়েছে পাড়া-প্রতিবেশীর কটু কথা। কিন্তু এ সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে নজির গড়েছেন চাকুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের সাহার বানু। পড়ুয়াদের অনুপ্রেরণা দিতে তাঁর সেই সংগ্রামের কথাই প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে চাকুলিয়া হাইস্কুলে তুলে ধরলেন এই কৃতী ছাত্রী।
কেমন ছিল লড়াইয়ের দিনগুলো? সাহার শোনালেন, বয়স যখন মাত্র তেরো, তখনই বাড়ি থেকে বিয়ের বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন বলে বিয়ে রুখে দেন। লড়াইয়ের সেই শুরু। বাহিন গ্রামে অল্প জমিতে চাষ করে বাবা মহম্মদ সালিমুদ্দিন কোনও মতে সংসার চালাতেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক আগে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে সাত দিনের মধ্যে মৃত্যু হল বাবার। সব যেন এক লহমায় থেমে গেল। কিন্তু সাহারের লড়াই থামেনি। চাকুলিয়া হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেন তিনি। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে তা সম্ভব হয়নি। গ্রাম থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কানকি জৈন বিদ্যামন্দিরে উচ্চমাধ্যমিকে কলা বিভাগে ভর্তি হন।
সালটা তখন ২০১০। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঘটল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ভুটভুটি পাল্টি খেয়ে নয়ানজুলিতে পড়ে গিয়ে আগুন ধরে গেল। প্রায় ৬০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে টানা ৯ মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়। সাহারের কথায়, ‘‘একটা সময় মনে হয়েছিল হয়তো আর বেঁচে ফিরব না।’’ আত্মীয়-পড়শিরা অবশ্য দেখতে এসে জানিয়ে যেতেন, ‘একে বাপ নেই, তার পরেও মেয়ে হয়ে বেশি পড়াশোনার শখ! তার ফল তো এমনটাই হয়।’
তাঁদের সেই কথার জবাব দিয়েছিলেন সাহার। অসুস্থ অবস্থায় পরীক্ষা বসে উচ্চ মাধ্যমিকে ৭৬ শতাংশ নম্বর পান। ইসলামপুর কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে ২০১৭ সালে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। সম্প্রতি রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন সাহার।
১০ বছরের লড়াইয়ের কথা ভাগ করে নিতে গিয়ে সাহার বললেন, ‘‘সে দিনের ওদের কথাগুলো পোড়া শরীরে তিরের মতো বিঁধেছিল। হাসপাতালে শুয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিলাম। পড়াশোনার জেদ আরও বেড়ে গিয়েছিল। সব সময় পাশে স্কুল শিক্ষকদের পেয়েছি। বিশেষ করে পাশে ছিলেন রফিকুল স্যার। তিনি সব সময় সাহস জোগাতেন।’’
শরীরে এখনও ক্ষত রয়েছে। ঝলসে যাওয়া চামড়া গলে গিয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রামে সব সময় পাশে ছিলেন মা সেলিনা খাতুন ও বড় দিদি ফরজানা খাতুনও। সাহার জানালেন, তাঁদের অক্ষরজ্ঞান হয়নি ঠিকই, কিন্তু দু’জনেই মহৎ শিক্ষার অধিকারী। তাঁদের গোটা পরিবারেই কেউ হাইস্কুলের গণ্ডি পার করেননি। তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মা বাড়িতে হাঁস মুরগি ও ছাগল পালন করেন। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এক ভাই ভিন্ রাজ্যের শ্রমিক। বড় ভাই মানসিক ভারসাম্যহীন। এই অভাবের সংসারে লড়াই কবে থামবে, তা সাহার জানেন না। ভবিষ্যতে ইচ্ছা, কলেজের শিক্ষক হওয়ার।
চাকুলিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বাসুদেব দে বলেন, ‘‘প্রজাতন্ত্র দিবসে সাহারকে সংবর্ধনা জানানো হল। তাঁর সংগ্রাম পড়ুয়াদের প্রেরণা।’’ স্কুলের শিক্ষক রফিকুল ইসলামের কথায়, ‘‘পড়াশোনায় ওর আগ্রহ দেখে সব সময় উৎসাহ দিতাম। ওকে নিয়ে গোটা স্কুল গর্বিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy