বিসর্জনের ঘাটেও দাপট শব্দবাজির। শিলিগুড়িতে ছবিটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাকে।
শিলিগুড়িতে ৩ কোটি দেওয়ালির রাতে কলকাতায় ফোন করেছিলেন এক শিলিগুড়িবাসী। কিন্তু কোনও কথাই বলতে পারছিলেন না। ফোনের ও পাশে যিনি ছিলেন, তিনিও স্তম্ভিত, ‘‘এ সব কীসের আওয়াজ!’’ শিলিগুড়িবাসী ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন, ‘‘যুদ্ধক্ষেত্র নয়। বাজি ফাটছে!’’
ঠিক যেন পরপর শেল আর মর্টারের ফেটে পড়ার শব্দ। রবিবার এ ভাবেই রাত কাটিয়েছে শিলিগুড়ি। আতসবাজি তো ছিলই। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে শব্দবাজিও। যা দেখেশুনে স্থানীয় লোকজন বলছেন, হবেই তো। এ বার বাজির বাজারের তো রমরমা ছিল।
ব্যবসায়ী এবং সরকারি হিসেবও একই কথা বলছে। এই হিসেব অবশ্যই আতসবাজির। তাতেও দেখা যাচ্ছে গত বছরের তুলনায় এ বার বিক্রি বেড়েছে অনেকটা। বাজির কারবারিদের দাবি, দেওয়ালির বাজারে পাঁচ দিনে অন্তত ৩ কোটি টাকার বাজি বিক্রি হয়েছে। গত ২৬ অক্টোবর থেকে সেবক রোডের দুই মাইলে বাজি বাজার হয় প্রশাসনের উদ্যোগে। কলকাতা, দিল্লি, কেরল থেকে বিক্রেতারা এই বাজারে আসতবাজি নিয়ে আসেন। গত বছর এই বাজারে ভাটা পড়েছিল। সব মিলিয়ে দুই কোটি টাকার বাজিও বিক্রি হয়নি। ফলে অনেকে উৎসাহ হারান। গত বছর সেখানে ১৫৮ জন ব্যবসায়ী বাজি বাজারে ছিলেন। এ বছর তা কমে দাঁড়ায় ১৪৪ জনে। শিলিগুড়ি ফায়ার ক্র্যাকারস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অভিজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘এ বার সব মিলিয়ে বিক্রি তিন কোটির কাছাকাছি। আমরাও খুশি।’’
কিন্তু এ তো গেল আতসবাজি। আর শব্দবাজি কত বিক্রি হয়েছে? ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজি বাজার থেকে কোনও শব্দবাজি বিক্রি হয়নি। বিধান মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘পুলিশের সহযোগিতায় সেবক রোডে বাজি বাজার হয়েছে। শব্দবাজি বিক্রির প্রশ্নই নেই।’’ কিন্তু নাম প্রকাশ করতে না চেয়ে অনেকেই বলছেন, ‘‘আতসবাজিই যদি এত বিক্রি হয়, তা হলে শব্দবাজি কত ঢুকেছে শহরে, বুঝে নিন।’’
বুঝবেন আর কী, দীপাবলির দু’দিনে কানে কানে তা মালুম পেয়েছেন শিলিগুড়ির মানুষ। শহরের পুলিশ কমিশনার চেলিং সিমিক লেপচা জানান, রাস্তার বদলে বাড়ির ছাদ এ বার বেশি ব্যবহার হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছতেই আবাসন, বহুতলের ছাদ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আর জুয়ার আসরের খবর পেয়ে অভিযান হয়েছে ঠিকই। তবে হাতেনাতে কাউকে ধরা যায়নি।
শীর্ষে কোচবিহার
তবে বাজি বিক্রির দৌড়ে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে কোচবিহার জেলা। ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্তাদের অনুমান, এই জেলায় প্রায় ৪ কোটি টাকার আতসবাজি বিক্রি হয়েছে। তবে নিষিদ্ধ শব্দবাজির বিক্রি নিয়ে কোনও তথ্য নেই তাঁদের কাছে। কোচবিহার জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুব্রত সাহা বলেন, “জেলায় এ বার প্রায় ৪ কোটি টাকার আতসবাজির ব্যবসা হয়েছে বলে আমাদের অনুমান।” দিনহাটা মহকুমা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রানা গোস্বামী বলেন, “দিনহাটাতেই প্রায় এক কোটি টাকার আতসবাজি বিক্রি হয়েছে। গত বারের থেকে ব্যবসার অঙ্ক কিছুটা বেড়েছে।’’ ব্যবসায়ীরা জানান, জেলায় গত বার তুলনায় কোটি টাকার মতো বিক্রি বেড়েছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীদের কয়েক জন জানিয়েছেন, জেলা জুড়ে গোপনে শব্দবাজি বিক্রির কারবার হয়েছে। প্রায় ২ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। গত বারের থেকে বিক্রেতা কিছু কম থাকায় অনেকেই বাড়তি দাম নেন। তাদের হিসেব, গত বার জেলায় প্রায় দেড় কোটি টাকার শব্দবাজির ব্যবসা হয়েছিল। পুলিশ জানিয়েছে, কোচবিহার, দিনহাটা থেকে প্রচুর শব্দবাজি উদ্ধার হয়। তবে কেউ গ্রেফতার হয়নি। শব্দবাজি রুখতেও কোনও মামলা হয়নি। কোতোয়ালি থানা সূত্রের খবর, কালীপুজোর রাতে রাজমাতা দিঘি লাগোয়া এলাকা থেকে ফোনে শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগ এসেছিল। পুলিশের টহলদার ভ্যান ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই সবাই পালিয়ে যায়।
কোটি টাকার বেশি
ব্যবসায়ীদের একাংশ জানান, রায়গঞ্জে অন্তত ২৫ লক্ষ টাকার আতসবাজি বিক্রি হয়েছে। উত্তর দিনাজপুর জেলায় সব মিলিয়ে সেই হিসাব ৮০ লক্ষ টাকার মতো বলে জানান মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অতনুবন্ধু লাহিড়ি। ব্যবসায়ীদের একাংশের সন্দেহ, এ বছর গোটা জেলায় এক কোটি টাকারও বেশি শব্দবাজির ব্যবসা হয়েছে। রবিবার রায়গঞ্জের মোহনবাটি, উকিলপাড়া, লাইনবাজার, সুদর্শনপুর, শিলিগুড়িমোড়, বিধাননগর, কসবা, দেবীনগর-সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যেই শব্দবাজি বিক্রি হতে দেখা গিয়েছে। রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ, ইটাহার, করণদিঘি, গোয়ালপোখর, চাকুলিয়া, ইসলামপুর ও চোপড়া থানা এলাকায় শব্দবাজির কারবার ও ব্যবহার রুখতে এ বছর পুলিশের কড়া নজরদারি ও তল্লাশি ছিল। উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার অমিতকুমার ভরত রাঠৌরের দাবি, পুলিশের নজরদারি ও তল্লাশির জারি থাকায় এ বছর অনেক কম পরিমাণে শব্দবাজি বিক্রি হয়েছে! অভিযুক্ত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
ক্ষতি মালদহে
গত বছরের তুলনায় বাজি বিক্রি বেড়েছে বলে মনে করেন বাজি ব্যবসায়ী মানিক জায়সবাল। যদিও শব্দবাজি বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ায় এবং পুলিশি তল্লাশি অভিযান চলায় বাজি কারবারিদের ক্ষতিই হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। ব্যবসায়ী সংগঠনের তরফেই জানানো হয়েছে, শব্দবাজি ছাড়া সাধারণ আতসবাজির মোট ব্যবসা হয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা। মালদহ মার্চেন্ট চেম্বার অব কমার্সের সম্পাদক উজ্জ্বল সাহা বলেন, ‘‘পুলিশের তরফে দফায় দফায় শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আগাম যে সব বাজি নিয়ে এসেছিলেন, নিষিদ্ধ হওয়ায় তার অনেকটাই নষ্ট করে দিতে হয়েছে। তাই বাজির কারবারিদের সব মিলিয়ে ২০ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’’
ব্যবসা হল কোথায়
দক্ষিণ দিনাজপুরে শব্দবাজি কম ফেটেছে বলেই ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের দাবি। সব মিলিয়ে জেলায় ৭০ লক্ষ টাকার মতো আসতবাজি বিক্রি হয়েছে বলে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি সূত্রেই জানা গিয়েছে। জেলায় বাজির পাইকারি বিক্রেতা রয়েছেন ৫-৬ জন। তাঁদের থেকেই বিভিন্ন জায়গায় বাজি সরবরাহ হয়েছে। বালুরঘাট শহরে ৪০ লক্ষ টাকার মতো বাজি বিক্রি হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। বালুরঘাটের তহ বাজারের ব্যবসায়ী রতন ঘোষ বলেন, ‘‘গত বছর অনেক বাজি বিক্রি করেছি। এ বছর ততটা হয়নি।’’
চোরাগোপ্তা বিক্রি
জলপাইগুড়িতে ৫০ লক্ষ টাকার বাজি বিক্রি হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের অনেকের। তবে চোরাগোপ্তা নিষিদ্ধ বাজি বিক্রিও যে কম হয়নি, সেটাও ব্যবসায়ীদের কয়েক জন মানছেন। তাঁরা জানান, অন্তত ২৫ লক্ষ টাকার নিষিদ্ধ শব্দবাজি বিক্রি হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy