হতাশ: রায়পুর চা বাগানে এক শ্রমিক। নিজস্ব চিত্র
দৈত্যাকার চা-কারখানার গেট থেকে ডান দিকে বাঁক নেওয়া রাস্তাটি ইদানীং ঘাসে ঢেকেছে। রাস্তার পাশে দিয়ে কাশফুল মাথা দোলাচ্ছে আগের মতোই। শুধু বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সকালে কারখানার গেটের সামনে দু’পাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির সারি আর দেখা যায় না। ওই সারির মধ্যেই প্রথম হুড খোলা বিদেশি গাড়ি দেখেছিলেন বিতনা বরাকই। তখন তাঁর যুবক বয়স ছিল। এখন শরীরে অনেকটাই সামনে ঝুঁকে পড়েছে। এ বছর বিশ্বকর্মা পুজো হবে না বিতনাদের চা বাগানে। প্রায় দু’বছর ধরে বাগানে মালিক নেই। গত বছর কয়েক জন মিলে চাঁদা তুলে পুজো করেছিলেন। এ বছর সে সামর্থ্য নেই জলপাইগুড়ি শহর ছোঁয়া রায়পুর চা বাগানে।
তিস্তার বাঁধ থেকে রাস্তা নেমে এসেছে রায়পুর চা বাগানের কারখানার সামনে। বাগানে ঢুকেই বাঁ পাশে কারখানা। কারখানার পাশে নাটমন্দির। তাতে ফুট তিনেকের কালী প্রতিমা। মূর্তির সামনে ধুলো জমেছে। অনেক দিন সেখানে নৈবেদ্যের থালা সাজেনি। প্রতিমার সামনে দু’দিকে বাঁশের ওপর রাখা প্রদীপে আধপোড়া সলতে রাখা, মাটির প্রদীপের গায়ে তেল চোয়ানোর টাটকা ছাপ। বাগানের কর্মী কাজল ঘোষ বললেন, “প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় এখন শুধু প্রদীপটুকুই জ্বালানো হয়। একটা সময় ছিল বিশ্বকর্মা পুজো থেকেই দুর্গাপুজোর বাজনা বেজে যেত বাগানে।”
বছর দুয়েক আগেও বিশ্বকর্মা পুজোর সকালে সামিনায়া খাটানো হত বাগানে। ম্যানেজার এসে বসতেন কাঠের হাতল দেওয়া কেতাদুরস্ত চেয়ারে। শ্রমিকরা ধামসা মাদল নিয়ে নাচগান করতেন। রঙিন কাগজের টুকরো, আলোর মালায় সাজানো হতো চা বাগান। শ্রমিক পরিবারের সকলকে দু’বেলা পেটপুরে খিচুড়ি খাওয়ানো হত। কারখানার গেটের সামনে বেলুন, কাচের চুড়ি, খেলনার দোকানের মেলা বসে যেত। বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন দুপুরে সেই বাগানে কারখানার সামনে লোকই খুঁজে পাওয়া গেল না। কয়েক জন বয়স্ক মানুষ নিঃঝুম দুপুরে সুনসান বাগানে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন শুধু।
কারখানা বন্ধ বেশ কয়েক বছর। ২০০৩ সালে প্রথম বাগান বন্ধ হয়। তার পর মালিকানা বদলেছে কয়েক বার। কারখানা বন্ধ থাকলেও পুজো হয়েছে। পাত পেড়ে শ্রমিকদের খিচুড়ি খাওয়ার ডাকও পড়েছে। বাগানের কর্মী সুকুমার দেব বললেন, “মালিক তো নেই! পুজোটা করবে কে? কাঁচা পাতা তুলে তা বেচে মাত্র ৮০-৯০ টাকা আয় হয় এক এক দিনে।” দু’এক জন বলেন, সাড়ে চারশো কর্মী রয়েছেন এই বাগানে। বটলিফ প্লান্টের জন্য তাঁরা যে পাতা তোলেন, সেটা বেচে মাথাপিছু এর থেকে বেশি হয় না।
ছোটবেলায় দেখা বিদেশি গাড়িটা এখনও চোখে ভাসে বিতনা বরাইকের। গাড়িটা ছিল তৎকালীন মালিকের। সেই ঠাঁট আর নেই। বাগানটিও পরিত্যক্ত হতে চলেছে, বুঝছেন প্রবীণ এই চা শ্রমিক। বললেন, “এ বারও ভোটের আগে বাগান খোলার কথা শুনলাম। তার পর সব চুপ। আমাদের আর অচ্ছে দিন আসবে না!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy