Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Delhi Violence

দেশজুড়ে হানাহানি দ্বেষপ্রেমীদের তারই মাঝে ভরসা দিচ্ছে ‘মানুষ’

শিরদাঁড়া বেয়ে নেমেছে ভয়ের স্রোত। কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।

অভিরূপ দত্ত
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২০ ১৭:৩৭
Share: Save:

ছবি ১: রক্তাক্ত শরীর ঘিরে পরপর লাঠির আঘাত করে চলেছে কিছু উন্মত্ত লোক।

ছবি ২: হাতে পাথর নিয়ে ছুটে আসছে একদ‌ল লোক, তাদের সামনে এক যুবকের হাতে তাক করা আগ্নেয়াস্ত্র।

ছবি ৩: মালপত্র নেওয়ার খাঁচা সদৃশ গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে যাচ্ছে একদল লোক।

এরকম বেশ কিছু ছবি খবরের কাগজ আর সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এখন প্রায় সবারই চেনা। সম্প্রতি সিএএ-এনআরসি সংক্রান্ত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে হয়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হানাহানির রক্তাক্ত ছবি। যা দেখে হয়তো শিউড়ে উঠেছেন অধিকাংশ পাঠক। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমেছে ভয়ের স্রোত। কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। দেশের রাজধানীতে ঘটে যাওয়া এমন নারকীয় ঘটনা নিজেদের দোরগোড়ায় ঘটলে কী হবে তা ভেবেও হয়তো অনেকে মনে মনে ভয় পেয়েছেন। আর ঠিক এখানেই হয়তো আপাতত এক কদম এগিয়ে গিয়েছে হিংসা ছড়ানোর নেপথ্যে থাকা কাণ্ডারিরা। কারণ তারা জানে এই ভয় থেকেই জন্ম নেয় অবিশ্বাস। আর সেই অবিশ্বাসকে হাওয়া দিয়ে তীব্রতর করে তোলার জন্য আগে থেকেই তৈরি হয়ে রয়েছে প্রশিক্ষিত সোশ্যাল মিডিয়ার বাহিনী। এখন ডিজিটাল যুগ। প্রায় সবার হাতেই রয়েছে র্স্মাটফোন। তার সঙ্গে জুড়েছে স্বপ্ল খরচের নেট পরিষেবা বা কোথাও কোথাও বিনামূল্যে ওয়াইফাই পরিষেবাও। মানবসমাজের উন্নতির জন্য হওয়া আবিষ্কারকে ক্ষতির জন্য ব্যবহার করার লোকের অভাব আগেও ছিল না, এখনও নেই। তাই হিংসা-হানাহানির ছবির ভুল ব্যাখা করে, ভুয়ো ছবি ও ভিডিয়ো প্রচার করে লোক ক্ষেপানোর চেষ্টা সমানে চলছে। সমাজের সংখ্যাগুরু হোক বা সংখ্যালঘু, দুই পক্ষেই রয়েছে হিংসা ছড়ানোর এমন বাহিনী। যাদের নিয়ন্ত্রণের সুতো সম্ভবত রয়েছে আরও উপরের কারও হাতে।

একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সাধারণত যেখানে যেখানে হিংসা ছড়িয়েছে সেখানে সেখানেই আগে উস্কানিমূলক ভাষণ দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরিকল্পনামাফিক ছড়ানো হয়েছে উস্কানিমূলক বক্তব্যের ভিডিয়ো ফুটেজ। দোসর হয়েছে অসংখ্য ভুয়ো ছবিও। আর এ সবের জেরেই সম্প্রতি দিল্লিতে ঝরে গিয়েছে বেশ কিছু প্রাণ। সিএএ-এনআরসি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষের আন্দোলনের আঁচ এসে লেগেছিল এ রাজ্যে, উত্তরবঙ্গেও। তার জেরে পুড়েছে সরকারি সম্পত্তিও। আর সেই ঘটনাকে ঘিরে দু’পক্ষ যে যার মতো মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। বাংলায় সেই চেষ্টা চলছে এখনও। একটার পর একটা হানাহানির ঘটনা ঘটানো হয় আর তাকে ঘিরে অন্য আরেকটি জায়গায় তৈরি করা হয় ভয়, অবিশ্বাস আর সন্দেহের পরত। যা থেকে রেহাই পায় না দীর্ঘ দিনের চেনা পড়শিও।

প্রশ্ন উঠতেই পারে সব সরকারের আমলেই তো সাম্প্রদায়িক হানাহানির নজির রয়েছে, এই আমল নিয়ে বারবার কথা বলা কেন। সেই উত্তর লুকিয়ে রয়েছে প্রশাসন বা সরকারের কাজেই। সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী শক্তিকে রুখতে এই আমলের কেন্দ্রীয় সরকার যে উদাসীন, তা বুঝতে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। কেন্দ্রে যে দলের সরকার রয়েছে, তাদের নেতারা ক্রমশ উস্কানিমূলক মন্তব্য করে গেলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গোষ্ঠীসংর্ঘষ রুখতে গেলে যেমন প্রশাসনকে শক্ত হতে হয়, নিরপেক্ষ হতে হয়। তেমনই পাল্টা রাজনৈতিক সচেতনতাও প্রয়োজন। দুর্ভাগ্য এই যে কট্টর হিন্দুত্ববাদী ধারণাকে অনুসরণ করা যে দল কেন্দ্রের মসনদে বসে রয়েছে। তাদের সঙ্গে আর্দশগত লড়াই করার মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক দল এখন প্রায় নেই। আঞ্চলিক দলগুলি রাজনৈতিক কারণে নিজেদের রাজ্যে বিরোধী অবস্থান নিলেও লড়াই করার মতো মতাদর্শের ভিত্তি, সাংগঠনিক অবস্থা বা ইচ্ছা কোনওটাই তাদের নেই। মতাদর্শগত ভাবে যে কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে থাকে যারা, সেই বামপন্থীরা সারা দেশে কিছু কিছু জায়গায়, শিক্ষাক্ষেত্রে নজরে পড়ে ঠিকই। কিন্তু নানা কারণে সামগ্রিক ভাবে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে তাদের শক্তি বেশ কম, কিছুটা ছন্নছাড়াও। অর্থবল আর সাংগঠনিক দিক থেকেও আপাতত হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির থেকে পিছিয়ে। তবুও পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক, আশা ছাড়া যায় না। কারণ এত কিছুর মধ্যেও ভরসার ছবিটাও রয়েছে। আর তা দেখাচ্ছেন দেশবাসী। হানাহানিতে বিধ্বস্ত দিল্লিতে শিববিহার এলাকায় উন্মত্ত জনতার হাত থেকে মুসলিম পড়শির পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে হিংসার শিকার হয়েছেন প্রেমকান্ত বঘেল। নিজে পুড়েও আগুনের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন কয়েকটি প্রাণ। প্রায় একই ছবি সংঘর্ষ বিধ্বস্ত চাঁদ বাগেও। অশান্তি, ভাঙচুরের কারণে বিয়েই ভেস্তে যেতে বসেছিল সাবিত্রী প্রসাদের। ‘ঘরের মেয়ের’ চোখের জল দেখে এগিয়ে এসেছিল পড়শি মুসলিম পরিবারগুলি। নির্ধারিত দিনেই সমস্ত আচার মেনে বিয়ে হয় সাবিত্রীর। আর গোটা সময় ওই পরিবারটিকে ঘিরে ছিল পড়শিরা। বোনের বিয়ে যাতে নির্বিঘ্নে হয় সে জন্য অনুষ্ঠানের বাড়ির চারদিকে সঙ্গীদের নিয়ে পাহারায় ছিলেন ‘ভাই’ আমির মালিক। দিল্লির মুসলিম প্রধান অঞ্চল মুস্তাফাবাদের বাবুনগর। সেখানে শিবমন্দির রক্ষা করেছেন স্থানীয় মুসলিমরাই। দুই সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা হাতে হাত মিলিয়ে রুখে দিয়েছেন সংঘর্ষ। টুকরো টুকরো এই ছবিগুলিই আসল ভারত। বিভেদকামী শক্তিগুলিকে পাল্লা দিতে নিরন্তর প্রচার প্রয়োজন এই ধরনের ঘটনারও। তবেই এগোবে বিভেদকামী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই। ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী অবস্থানে বরাবর পথ দেখিয়ে এসেছে বাংলা। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে নয়, সাংস্কৃতিক কারণেও। একাধিকবার সাম্প্রদায়িক শক্তির দাপাদাপিতে ক্ষতবিক্ষত হলেও বাংলার মানুষ, উত্তরবঙ্গের মানুষ বারবার রুখে দিয়েছেন ধর্মব্যবসায়ীদের চক্রান্ত। এখনও বাংলায় গাজনের মেলায়, দুর্গাপুজোর ভিড়ে কেউ ধর্ম খোঁজেন না। ইদের মিষ্টি কেনার সময় জানতে চান না দোকানদারের পরিচয়। কোচবিহারের রাসমেলায় আলতাফ মিয়াঁকে ছাড়া রাসচক্র তৈরি হয় না।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Delhi Violence CAA Protes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE