সিকিম রাজার কাছে লিজে নেওয়া হল দার্জিলিং। ১৮৩৫ সালে ১ ফেব্রুয়ারি কাগজপত্রের চুক্তিকে সিকিমের রাজা দার্জিলিংকে বিনামূল্যে ব্রিটিশদের লিজে দেন।
দার্জিলিঙের টয় ট্রেন। —নিজস্ব চিত্র।
ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে গড়ে উঠা দার্জিলিং আজ বিশ্বের দরবারে অন্যান্য পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। হেরিটেজ টয়ট্রেন, বাতাসিয়া লুপ, ঘুম, টাইগার হিল, সান্দাকফু, ফালুট, মানেভঞ্জন, পেশক, তাগদা কোথায় তখন? শুধুই চলছে যুদ্ধ। একটা বিচ্ছিন্ন পরিত্যক্ত জায়গার দখলদারিতে নেপাল, সিকিম ও ব্রিটিশরা।
১৮৫০ সালে ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ পত্রিকায় একটি ছবি ছাপা হয়। সাদাকালো ছবি। ঢেউ খেলানো পাহাড়, সামনে দু’জন মানুষ। এক ঝলকে বলা যেতেই পারে ইউরোপের কোনও গ্রামের ছবি। যা ব্রিটিশরা নিজেদের মতো করে গড়ে তোলে নিজেদের স্বার্থে। ইতিহাস জানাচ্ছে, দার্জিলিঙের আসল নাম ছিল, দর্জেলিং। দর্জে শব্দের অর্থ বজ্র ও লিং শব্দের অর্থ জায়গা। অর্থাৎ বজ্রের জায়গা। আজও দার্জিলিঙের যাঁরা পুরনো বাসিন্দা, বংশানুক্রমিক ভাবে যারা শৈল শহরের বিখ্যাত চা-বাগানগুলোর মালিক, যাঁদের আজও ধাতে রয়ে গিয়েছে খানিকটা সাহেবিপনা তাঁরা শখ করে আজও দার্জিলিংকে দর্জিলিং বলেন।
মূলত দার্জিলিং ছিল তিব্বতীদের সাধনার জায়গা। তিব্বতী ধর্মালম্বীরা দার্জিলিংকে পবিত্র স্থান বলে মনে করতেন। সন্ধান মেলে তিব্বতীদের উপাসনালয়ের। যা কি না ১৮১৫ সালে নেপালি গোর্খাদের আক্রমণে ধংসপ্রাপ্ত হয়। এখনকার এবং অতীতের দার্জিলিঙের ভৌগোলিক পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন ঘটেনি ক্ষমতা দখলের। আজও রাজনৈতিক সমীকরণে জেরবার শৈল শহর। তাকে দখল করাকে কেন্দ্র করে ঘটেছিল একই ঘটনা। আসলে তার সৌন্দর্যই বোধ হয় কাল হয়েছে দার্জিলিঙের। এ শহরের ইতিহাসের সঙ্গে সিকিম, নেপাল, ভূটান ও তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত এক সুতোয় গাঁধা। এক সময় দার্জিলিঙের খানিকটা নেপাল এবং বেশ কিছুটা অংশ সিকিমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শাসন করতেন সিকিমের রাজা। সেই সময় দার্জিলিংকে বাফার জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হত। দার্জিলিং দখলকে কেন্দ্র করে সিকিমের সঙ্গে নেপালের দন্ধ ছিল নিত্যদিনকার ঘটনা। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দার্জিলিং-সহ পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি এলাকা পরিচালনা করত সিকিম এবং তরাই-সহ শিলিগুড়ি পরিচালনা করত নেপাল।
পাহাড়ি এলাকাকে পাখির চোখ করে গোর্খারা ঝাঁপিয়ে পড়ে দার্জিলিঙের উপর। একের পর আক্রমণ। গোর্খারা যুদ্ধে ভয় পায় এই প্রবাদ হয়তো সেই সময় থেকেই প্রচলিত। আসতে আসতে পিছু হটতে লাগল সিকিম। প্রায় হাতছাড়া হতে লাগল সাধের দার্জিলিং। একটা সময় সিকিম তিস্তা নদীর তীর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। অগত্যা তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের দ্বারস্থ হল সিকিম।
ইতিহাসে তৃতীয় জনের প্রবেশ ঘটল। ১৮১৪ সালে ইঙ্গো-গোর্খা যুদ্ধের ফলে ভৌগলিক চুক্তি সাক্ষর করতে বাধ্য হয় নেপাল। পরাজিত নেপাল দখল হওয়া দার্জিলিঙের উপর অধিকার হারায়, মেচি নদী থেকে তিস্তা পর্যন্ত এলাকা ব্রিটিশ রাজের কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং ১৮১৭ সালে ব্রিটিশরা সেই জমি পুনরায় সিকিম রাজ্যকে ফিরিয়ে দিলেও প্রায় ১২ বছর পর গোটা দার্জিলিংই ব্রিটিশদের ঝুলিতে আসে।
ঘটনার সূত্রপাত সেই নেপাল ও সিকিম যুদ্ধ। তবে এ বার দার্জিলিং নিয়ে নয়, সমস্যা শুরু হয় ‘অন্তদারা’ সীমান্ত নিয়ে। সেই সমস্যার সমাধানে ফের ইংরেজ সরকার। তৎকালীন বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ব্রিটিশ প্রতিনিধি হিসাবে সমস্যার সামধান করতে ক্যাপ্টেন জর্জ আলমার লিওড ও জে ডবলিউ গ্রেন্ডকে দূত হিসবে পাঠালে তারা দার্জিলিঙে বিশ্রামের জন্য রাত্রিযাপন করেন। প্রকৃতির অপরূপ মুগ্ধতা দেখে তারা গর্ভনর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে দার্জিলিঙে স্বাস্থ্যনিবাস তৈরির আবেদন জানান। স্বপ্ন সত্যি হতে সময় লাগেনি।
সিকিম রাজার কাছে লিজে নেওয়া হল দার্জিলিং। ১৮৩৫ সালে ১ ফেব্রুয়ারি কাগজপত্রের চুক্তিকে সিকিমের রাজা দার্জিলিংকে বিনামূল্যে ব্রিটিশদের লিজে দেন। ব্রিটিশ শাসনের জেরেই নেপালি গোর্খাদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায় সিকিম। তবে ইংরেজরা এক হাজার ‘রুপি’ করে সিকিম রাজাকে দিতে থাকে দার্জিলিঙের বদলে। যা পরবর্তীতে ১৮৪৬ সালে ছয় হাজার ‘রুপি’তে পরিণত হয়।
ব্রিটিশরা যখন দার্জিলিং লিজে নিল, তখন বসতি বলতে প্রায় শতাধিক মানুষ। দূরদূরান্তে কয়েকটি বাড়ি দেখা যেত। বাকি সবটাই পাহাড় ও জঙ্গল। নিজেদের ফেলে আসা দেশের মতো করে দার্জিলিঙে বানানো শুরু করে ইংরেজ সরকার। আস্তে আস্তে নির্মাণ হয় রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, চার্চ, রেল লাইন, স্কুল-কলেজ। একমাত্র দার্জিলিঙের কারণেই সেই সময় শিলিগুড়িতে তৈরি হয় হিলকার্ট রোড ও তার উপর দিয়ে রেললাইন। কলকাতা থেকে তৎকালীন নব নির্মিত শিলিগুড়ির টাউন স্টেশন ও সেখান থেকে খেলনা গাড়ি করে দার্জিলিং।
সুতরাং, ভৌগলিক দিক থেকে গোটা এলাকার উন্নতি সাধন ঘটাতেই হত। তার আগে পর্যন্ত দার্জিলিঙে উঠতে গেলে ভরসা একমাত্র খচ্চর। গোটা দেশের কাছে দার্জিলিং নামে এক নতুন জায়গার সন্ধান দেয় ব্রিটিশ সরকার। ইংরেজদের পাশাপাশি গোটা দেশ থেকে বিভিন্ন রাজা, রায় বাহাদুর খেতাব প্রাপ্ত জমিদাররাও আসতে লাগলেন তৎকালীন দর্জিলিঙে। ইংরেজদের দৌলতেই পাহাড়ের গায়ে লাগল চা গাছ। শুধুমাত্র ভ্রমণ বা স্বাস্থ্যের উন্নিতি সাধন নয়, দার্জিলিং হয়ে উঠল ব্যবসার অন্যতম পীঠস্থান।
কিন্তু সিকিম রাজার থেকে নেওয়া জমিতে বিপুল আয়োজনে অল্প অল্প করে ব্রিটিশ ও সিকিমের সুসম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করল। চা-বাগানের দৌলতে সিকিম থেকেও বহু মানুষ আসতে শুরু করেন দার্জিলিঙে। নিজের দখলে থাকা জমিকে ফিরিয়ে নিতে সিকিমে ভ্রমণকারী দুই ব্রিটিশ অভিযাত্রীকে বন্দি করে সিকিম সরকার। শুরু হল রণকৌশল। ১৮৫০ সালে ৬৪০ বর্গমাইল এলাকা ব্রিটিশ সরকার ঘিরে ফেলে, চিরতরে সিকিম রাজার কাছ থেকে হাতছাড়া হল দার্জিলিং।
কালে কালে ব্রিটিশরা একের পর নিদর্শন তৈরি করে দার্জিলিং শহর জুড়ে। আজ দার্জিলিঙের ম্যাল থেকে শুরু করে বাতাসিয়া লুপ— সবই ইংরেজ শাসনের স্থাপত্য। সবটা আজও নষ্ট হয়ে যায়নি। রয়েছে বেশ কিছু চার্চ। রয়েছে তৎকালীন বিভিন্ন সাহেবের বাংলো। অনেক কিছুই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়। আবার অনেক কিছু হারিয়েও গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বেশ কয়েক বার এসেছেন এখানে। সেই পরিবারের লোক আজও বর্তমান। স্বাধীনতার পর দার্জিলিং নিজে থেকেই পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে উঠে। বাড়তে থাকে হোটেলের সংখ্যা। যা আজ আকাশ ছুঁই ছুঁই। বর্তমানে জায়গা মেলা দুষ্কর।
পাহাড়ের ধার বেয়ে নেমে গিয়েছে চা-বাগান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় সূর্যোদয়। অপরূপ সৌন্দর্য দার্জিলিঙের রাজনৈতিক সমীকরণ অশান্ত হয় বিমল গুরুঙের সময় থেকেই। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা-সুপ্রিমোর সময় প্রথম বার অশান্ত হয় দার্জিলিং। আগুল জ্বলে শৈল শহরে। এখনকার দার্জিলিং নতুন ভাবে তৈরি হওয়া একাধিক রাজনৈতিক দলের পাখির চোখ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy