বালুরঘাট দিবসে শহরে মিছিল নাগরিকদের। —অমিত মোহান্ত
ইংরেজ শাসন চূর্ণ করে বালুরঘাটের স্বাধীনতা লড়াইয়ের বিজয় গাথা স্মরণে বুধবার পালিত হল ‘বালুরঘাট দিবস।’ আয়োজক কমিটির সভাপতি পীযূষকান্তি দেব, সম্পাদক বিপ্লব মিত্র, সুশোভন চট্টোপাধ্যায় সহ শহরের বিশিষ্ট নাগরিকের উদ্যোগে আত্রেয়ী নদীর ডাঙিঘাটে এবং পুরনো প্রশাসনিক ভবন চত্বরে শহিদ স্মারক স্তম্ভে পুষ্পস্তবক দেওয়া হল। উপস্থিত ছিলেন জেলাশাসক সঞ্জয় বসু, জেলাপরিষদের সভাধিপতি ললিতা টিগ্গা। আলোচনায় ১৯৪২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরের টুকরো স্মৃতিকথা বক্তব্যে তুলে ধরেন প্রয়াত নেতা সরোজরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের নাতি সুশোভনবাবু এবং পীযূষবাবু।
এ দিন সকালে আত্রেয়ী নদীর ডাঙিঘাটে স্মারক স্তম্ভ চত্বরে সে দিনের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যুদ্ধ জিগিরের কথা স্মরণ করে নাগরিকদের এক মিছিল ডাঙিঘাট থেকে শহর পরিক্রমা করে প্রশাসনিক ভবন চত্বরে পৌঁছয়। সামিল ছিল বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। মেদিনীপুরের পরে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে বিয়াল্লিশের দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল।
বালুরঘাট শহর থেকে প্রায় ৪ কিমি দক্ষিণে আত্রেয়ীর ডাঙি খেয়াঘাটে ১৯৪২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস পতাকা কাঁধে নিয়ে তপন, বালুরঘাট, পোরসা, ধামরইরহাট থানার বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ১০ হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী মিছিল করে সন্ধ্যার মধ্যে ডাঙিঘাটে পৌঁছে যান। রাত ৮টা থেকে তিনটি বড় খেয়া নৌকায় পার হয়ে এক হাজার করে লোক নিয়ে জনতাকে দশটি ভাগে দাঁড় করানো হয়। একেবারে সামনের সারিতে পতাকা কাঁধে কংগ্রেস নেতা সরোজরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দু’পাশে কানু সেন ও শুটকা বাগচী। এরপর রাখা হয় তিরন্দাজ বাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র নেতা রাধামোহন মোহান্ত, পুণ্যেশ্বর বর্মন ও হরেন দাস। এ ছাড়া ১০টি দলে স্লোগান দিয়ে পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন শৈলেন দাস, পুলিনবিহারী দাশগুপ্ত, অজিত দত্ত, অমিয় মৈত্র, চন্দ্রিকা পান্ডে, তারা গুহ, প্রফুল্ল দেব, জব্বার আলি মিঁয়া প্রমুখ সংগ্রামীরা।
১৪ সেপ্টেম্বর সকালে সরোজবাবু নেতৃত্বে ডাঙিঘাট থেকে বালুরঘাট শহর অভিমুখে দৃপ্ত ভঙ্গিতে মিছিল করে এগিয়ে বালুরঘাট দখল করে নেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। দশ হাজার সংগ্রামীর ধ্বনিতে সে দিন বালুরঘাটের আকাশ বাতাস উত্তাল হয়ে ওঠে। বালুরঘাট শহরের ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল নড়ে ওঠে। থানার সিপাই দারোগারা চকভবানী কালীবাড়ির ডোবায় রাইফেল লুকিয়ে গা ঢাকা দেন। স্বাধীনতা যোদ্ধারা কার্যত বিনা বাধায় শহরে প্রবেশ করে ট্রেজারি অবরোধ করে ফৌজদারি আদালতের বারান্দা ঘেঁষে তীরন্দাজ বাহিনী দাঁড়িয়ে পড়েন। আদালত থেকে ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত কংগ্রেস পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়।
সে দিন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রোষাগ্নিতে বালুরঘাট শহরের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের ১৬টি অফিস ভস্মীভূত হয়। দেওয়ানি আদালতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দেওয়াল-সিন্দুক ভেঙে আট হাজার খুচরো পয়সা আদালতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তিন দিন ধরে আদালত ভবনের দলিল দস্তাবেজ ও আসবাব পুড়েছিল।
ঘটনার দিন ভোর থেকে বালুরঘাট বাইরের এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। টেলিফোনের তার কেটে বাস সার্ভিস থেকে সড়ক সংযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বালুরঘাট শহরের পর এই মহকুমার ডাঙি, মদনাহার, লস্করহাট, পারিলা ও মরাডাঙা সহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পারিলাহাটে ইংরেজ পুলিশের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রায় এক ঘন্টা ধরে রাইফেল এবং তীর ধনুকের অসম যুদ্ধ চলে। পুলিশের গুলিতে ৪ জন স্বাধীনতা যোদ্ধার মৃত্যু হয়। জখম হন ৩৭ জন। এরপর শুরু হয় পুলিশের অত্যাচার। ধরপাকড়ের জেরে গ্রাম শহর জনশূন্য হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বালুরঘাট অভিযানের ১০ দিনের উত্তেজক অধ্যায়।
বালুরঘাটে সে দিনের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সকলেই আজ প্রয়াত। তাদের স্মরণে পুরনো ট্রেজারি ভবন চত্বরের একটি ঘরে সেকালের টুকরো ছবি ও স্মৃতিচিহৃ সংরক্ষণের দাবি এ দিন উঠে এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy