Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Tea Worker

দেখা-অদেখার বোধন, বিসর্জন

চা পাতা মহিলারাই সব থেকে ভাল তুলতে পারে। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি বেছে ছিঁড়তে হয় গাছ থেকে। বেশি জোরে টেনে পাতা ছিঁড়লে গাছের ব্যথা লাগে। গাছ কষ্ট পেলে পরের বার ভাল পাতা দেয় না।

অঙ্কন: অমিতাভ চন্দ্র

অঙ্কন: অমিতাভ চন্দ্র

মেনকা রায়
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৪৩
Share: Save:

চার বছর হয়ে গেল দুর্গা ঠাকুরের সামনে গিয়ে দাঁড়াইনি। তবু অষ্টমীর দিন একটা পরিষ্কার শাড়ি পরি। সকাল সকাল স্নানও করি। দুর্গাপুজোর চারটে দিন বাড়ি থেকে বেরই হই না।

কিন্তু ঢাকের শব্দ পেলে মনের ভেতর কে যেন নেচে ওঠে। সেই ফেলে আসা ছোটবেলার আমিটাই হয়তো বা। যে ‘আমি’টা বাবার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যেত। বাবা অন্যের জমিতে কাজ করতেন। যাঁর জমি, তাঁকে আমরা দাদু বলতাম। প্রতিবার অষ্টমীর দিন আমরা শহরে দাদুর বাড়িতে যেতাম। দুপুরে দাদুর বাড়িতে খাওয়া হত। মাংস-ভাত, মিষ্টি। তার পর দাদু আমাদের হাতে টাকা দিতেন। বাবাকেও দিতেন। বাবা আমাদের সারা শহর ঘুরিয়ে ঠাকুর দেখাত। একবার বাবা বলে দিয়েছিল, ঠাকুরের কাছে কিছু চেয়ে প্রণাম করলে ঠাকুর সেই চাওয়া পূরণ করে। ছোটবেলায় আমি ঠাকুরকে বলতাম, প্রতিবার যেন পুজোর সময়ে এমন মজা করে ঘুরতে পারি। বাড়ি ফেরার সময়ে বাবা বেলুন কিনে দিত। কোনও বারই সেই বেলুন বাড়ি পর্যন্ত আনতে পারিনি। আগেই ফেটে গিয়েছে, নয়তো উড়ে গিয়েছে।

এখন বাগানে কাজের ফাঁকে আকাশে শরৎ এলে সব কথা মনে পড়ে। পাতা তুলতে তুলতেই। পুজোর ক’দিন ছুটি থাকে আমাদের। যদিও চার বছর ধরে আমার যে দুর্গা ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হয় না।

চা পাতা মহিলারাই সব থেকে ভাল তুলতে পারে। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি বেছে ছিঁড়তে হয় গাছ থেকে। বেশি জোরে টেনে পাতা ছিঁড়লে গাছের ব্যথা লাগে। গাছ কষ্ট পেলে পরের বার ভাল পাতা দেয় না। যে পাতা, কুঁড়ি ছিঁড়ে আনা হয়, সেটিকেও শক্ত করে ধরা যায় না। তাতে ওর স্বাদ-গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়। সে জন্য মেয়েদের নরম হাতেই চা পাতা ছিঁড়তে হয়। শরৎকালের আগমন চা পাতায় টের পাওয়া যায়। শেষ রাত থেকে হিম পড়তে শুরু করে। সকালে পাতা ছিঁড়তে গেলে হাতে যখন শিশির লাগে, বুঝতে পারি, পুজো চলে এলো। চা বাগানের কোনায় কোনায় কাশফুল ওঠে। চা গাছের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে কোনদিকে বাগানের শেষ দেখা যায় না। মনে হয়, নীল আকাশটা নেমে এসে বোধহয় সবুজ বাগিচায় মিশে গিয়েছে।

শরৎকালের আকাশে সাদা মেঘ থাকে, ছেঁড়া ছেঁড়া। শরৎকালে আমাদের বোনাস হয়। আমি যে চা বাগানে কাজ করি সেটি খুব একটা বড় নয়। ছোট চা বাগান। আমাদের মজুরিও কম। দিনে দুশো টাকার কাছাকাছি। এখন দুর্গাপুজোর অপেক্ষা করি বোনাসের জন্য। বোনাসের টাকা দিয়ে ছেলে আর মেয়ের জন্য নতুন জামা কিনি। প্রতিবার বোনাসের আগে শুনি বেশি টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু হাতে বেশি পাই না। কয়েক বছর ধরে শুনছি আমাদের মজুরি বাড়বে। তা-ও বাড়ে না। চা বাগানে পাতা তুলে সংসার চালানো দিনদিন কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। সরষের তেলের দাম অনেক বেড়ে গেছে। বাজারে আলুর দামও বেশি। পুকুরে, নদীতে পাওয়া ছোট ছোট মাছের দাম আগে কম ছিল, এখন মাছের দামও বেশি। চা বাগানের বাইরে গ্রামের বাজারে একটা ডিমের দামও সাড়ে ছয় টাকা। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলেটাকে নিয়ে থাকি, তবু এই বাজারের দামে রোজ ডালের সঙ্গে তরকারিও রান্না হয় না। বোনাসের টাকা দিয়ে পুজোর এক দু’দিন ছেলেটাকে মাংস রেঁধে দেব, একদিন ডিমের ঝোল করে দেব। ছেলেটা প্রতিবারই আমাকে জোর করে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এ বারও হয়তো করবে। এ বারও হয়তো ঠাকুরের মুখোমুখি দাঁড়ানো হবে না।

ছোটবেলায় আমাকে স্কুলে পাঠায়নি বাবা। পরে বলেছিল, আমাকে নাকি স্কুলে পাঠাতে পারেনি। আমার ভাই স্কুলে গিয়েছিল। আমার যে ক’জন বান্ধবী ছিল, ওরাও স্কুলে পড়ত। শুনেছি, ওরা স্কুলে বড় বড় পরীক্ষা দিত। সে সব পরীক্ষা নিশ্চয়ই খুব শক্ত ছিল। আমার যখন বিয়ে হল, তখনও আমার বান্ধবীরা স্কুলে পড়ে। বিয়ের রাতে শ্বশুরবাড়ির একজন আমার থুতনি ধরে নাড়িয়ে বলেছিল, “একেবারে মা দুগ্গা।” সেই থেকে দুর্গাপুজো শুনলেই এই কথাটা মনে পড়ত।

বিয়ের পরে স্বামীর সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যেতাম। একবার মণ্ডপে দাঁড়িয়ে স্বামীকে বলেছিলাম সেই কথাটা। বলেছিলাম, তোমাদের বাড়িতেও আমাকে দুর্গা বলে। স্বামী হেসেছিল। একটা মেয়ে হল, একটা ছেলে। তার পরেই হঠাৎ স্বামী অসুখে ভুগে মরে গেল। যিনি আমাকে বিয়ের রাতে দুর্গা বলেছিলেন, তিনিই হাতে ধরে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। এখন দুর্গাপুজো শুনলেই বিয়ের রাতের কথা এবং স্বামী মারা যাওয়ার পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা একসঙ্গে মনে পড়ে।

বয়স ষাট হতে চলল। চা বাগানে কাজের নাকি বয়স থাকে। ইংরেজিতে একটা কী শব্দ বলল। সেটা নাকি আমার হবে। তার পরে আর কাজ থাকবে না। এতগুলো বছর ধরে বাগানে আছি। স্বামী মারা যাওয়ার পরে চা পাতা তুলতে শুরু করি। বাগানই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ছেলেমেয়ে দুজনকেই পড়িয়েছি চা পাতা তুলে। বাগানের নেতারা এসে আমাকে বলে, আমার জীবনের মতো লড়াই নাকি আর কারও নেই। সে সব আমি জানি না। তবে একদিন আমাদেরই চা বাগানের একজন আমাকে বলেছিল, “দিদি তুমি তো দুর্গার মতো দশ হাতে লড়াই করে ছেলে-মেয়েকে বড় করলে। নিজেও ভাল আছ।”

কিন্তু চার বছর হয়ে গেল দুর্গা ঠাকুরের মুখোমুখি দাঁড়ানো হয়নি আমার। ওই টানা টানা চোখ, নাকে নথ, ওই ত্রিনয়ন আমার বুকে কেমন যেন উথালপাথাল করে দেয়। পুজোর ক’দিন বাড়ির কাজ না থাকলে চা বাগানের গাছের ছায়াতেই বসে থাকি। দশমীর দিন সকাল থেকে বিসর্জনের বাজনা বাজে। চা বাগানের আশেপাশে অনেক ক’টি পুজো হয়। আমাদের বাগানের ঠাকুর বিকেলবেলায় ভাসান নিয়ে যায়। ঢাকের শব্দ দূরে মিলিয়ে যায়। তখন প্রতিবারই আপনাআপনি হাত কপালে উঠে যায়। মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে যা, “মাগো, আবার এসো।”

যদিও এখন আর মণ্ডপে গিয়ে দুর্গা প্রতিমার সামনে দাঁড়ানো হয় না।

লেখিকা জলপাইগুড়ির রানিনগরের চা শ্রমিক

অনুলিখন: অনির্বাণ রায়a

অন্য বিষয়গুলি:

Tea Worker Siliguri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy