Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

মানসিক রোগীকে মার, ধৃত চার

সব্জি বাগানের বেড়া ভেঙে দিয়ে, বাগানে শুকনো ডালপালা জ্বালিয়ে ছিলেন ভবঘুরে, মানসিক রোগী এক যুবক। এই অভিযোগ তুলে এলাকার চার জন ওই যুবককে পিটিয়ে দু’হাত, পা ভেঙে দিয়েছে। ৯ মার্চ শিলিগুড়ির ফাঁসিদেওয়া ব্লকের ভুসিভিটা এলাকার এ ঘটনার পর পুলিশ মারধরে অভিযুক্ত চার জনকে সোমবার গ্রেফতার করে।

সৌমিত্র কুণ্ডু
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৪ ০১:২৪
Share: Save:

সব্জি বাগানের বেড়া ভেঙে দিয়ে, বাগানে শুকনো ডালপালা জ্বালিয়ে ছিলেন ভবঘুরে, মানসিক রোগী এক যুবক। এই অভিযোগ তুলে এলাকার চার জন ওই যুবককে পিটিয়ে দু’হাত, পা ভেঙে দিয়েছে। ৯ মার্চ শিলিগুড়ির ফাঁসিদেওয়া ব্লকের ভুসিভিটা এলাকার এ ঘটনার পর পুলিশ মারধরে অভিযুক্ত চার জনকে সোমবার গ্রেফতার করে।

গুরুতর জখম অবস্থায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন শ্যামল সিংহ নামে ওই ব্যক্তি। হাসপাতালের সুপার অমরেন্দ্রনাথ সরকার জানিয়েছেন, মারের চোটে শ্যামল বাবুর বাঁ হাতের মাঝামাঝি অংশ এবং ডান হাতের কব্জির কাছে ভেঙে গিয়েছে। ডান হাঁটুর নীচেও পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বাঁ পায়ের দিকে কোমরে চোট রয়েছে। গত সোমবার, ১০ মার্চ সন্ধ্যায় জখম শ্যামলের ভাই সতীলাল সিংহ পুলিশে অভিযোগ করেন। তার পরেই পুলিশ শশীলাল সিংহ, দীপু মণ্ডল, তার ভাই মৃন্ময় মণ্ডল এবং শোভানন্দ সিংহ নামে চার যুবককে গ্রেফতার করে। ফাঁসিদেওয়া থানার পুলিশ আধিকারিক কেনেথ ফনিং বলেন, “ধৃত চার জন জেল হেফাজতে রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে লাঠি, লোহার রড উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে।”

শ্যামলবাবুর বিরুদ্ধে ভুসিভিটার এক বাসিন্দার সব্জি বাগানের বেড়া ভেঙে, গাছের শুকনো ডালপালা খুলে রাতে আগুন পোহানোর অভিযোগ তুলে তাঁকে মারধর করা হয়। দাবি করা হয়, তিনি ওই বাগানের সব্জিও নষ্ট করছিলেন। রবিবার রাতেই বাঁশ, রড দিয়ে পিটিয়ে তাঁকে বালাসন নদীর ধারে ফেলে রেখে আসে ওই যুবকেরা। সকালে কয়েকজন বাসিন্দা নদীর তিরে প্রাতঃকৃত্য করতে গিয়ে শ্যামলকে গোঙাতে দেখেন। তাঁরাই খবর দিলে বাসিন্দা ও পরিজনেরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।

সোমবার শ্যামলকে উদ্ধার করার পর স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য জুলিদেবীর স্বামী বিষ্ণুলাল ও কয়েক জন বাসিন্দা মিলে সালিশি ডাকেন। সেখানে ঠিক হয় অভিযুক্তদের পরিবারের তরফে চিকিৎসায় খরচ করা হবে। তবে এর পর তাঁরা কেউ সে কথা রাখেনি বলে অভিযোগ। অভিযুক্ত শোভানন্দ আবার শ্যামলেরই আত্মীয়। শোভানন্দের দাদা স্বদেশ সিংহ বলেন, “শ্যামলদাকে এ ভাবে মারধর মোটেই ঠিক হয়নি। ভাই এ সব কাজে থাকে না। ওকে ডেকে নিয়ে যায় শশীলাল। শোভানন্দকে ফাঁসানো হয়েছে।” শ্যামলের ভাই দেবলাল সিংহ বলেন, “এ ভাবে কেউ কোনও জন্তু জানোয়ারকেও মারে না। সালিশিতে ওদের বাড়ির লোকেরা বলল দাদাকে সুস্থ করার দায়িত্ব নেবে। এক বারও কেউ এল না।”

এই ঘটনার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এলাকাবাসী। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান আনন্দ সিংহ, পঞ্চায়েত সদস্য জুলি ওঁরাও, তাঁর স্বামী বিষ্ণুলাল ওঁরাও, এলাকার বাসিন্দা তথা কংগ্রেস নেতা ফণি রায়-সহ বাসিন্দাদের একাংশ শ্যামলকে এ ভাবে মারধর করে জখম করার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। ঘটনার দিন এলাকার নানা জায়গায় তাঁকে ঘুরতে দেখেছেন বাসিন্দারা। তাঁদেরই একাংশ জানান, শ্যামলবাবু কারও কোনও ক্ষতি করতেন না।

শ্যামলবাবুরা চার ভাই আর তিন বোন। বোনদের বিয়ে হয়েছে। বাবা রাজেন সিংহ কৃষি কাজ করতেন। এখন বয়সের জন্য করতে পারেন না। শ্যামল বাদে বাকি তিন জন এখন চাষ আবাদ দেখে। বাড়িতে থাকেন মা মালতিদেবী। সতীলাল বলেন, “দিন কয়েক আগে শশীলাল লোকজন নিয়ে এসে বাড়িতে হুমকিও দিয়েছিল। ওদের খেতের বেড়া, সব্জি নাকি নষ্ট করছে শ্যামল। তাকে বিরত করতে না পারলে ওরা বড় ধরনের ক্ষতি করবে বলেছিল। কিন্তু এই ভাবে মারধর করে আধমরা করে রাখবে ভাবতে পারিনি।”

একসময় মেধাবী ছাত্র হিসাবেই এলাকায় পরিচিত ছিলেন শ্যামল। ভুসিভিটা প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র শ্যামল পরে ফাঁসিদেওয়া হাইস্কুল ও বাগডোগরার চিত্তরঞ্জন হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ক্লাসের প্রথম কয়েক জন কৃতি ছাত্রের মধ্যে তাঁর নাম থাকত। এর পরেই তিনি কোনও কারণে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বাড়িতে থাকতেন না। এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। রাতে প্রাথমিক স্কুলের বারান্দায়, কারও বাড়ির দাওয়ায় ঘুমিয়েই রাত কাটাতেন। কখনও বাড়িতে গেলেও উঠোনে বসে থাকতেন। জোর করে বাড়ির লোকেরা খাইয়ে দিতে চেষ্টা করলেও খেতেন না। প্রাথমিক স্কুল পড়ুয়াদের মিড ডে মিলের সময় সেখানে তাঁকে দেখা গেলে শিক্ষকেরা তাঁকেও খাবার দিতেন। আবার কখনও এলাকা ছেড়ে অন্যত্র কিছু দিন কাটিয়ে ফিরতেন। এ করেই তাঁর দিন চলছিল।

পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রেই জানা গিয়েছে, ঘটনার দিন শশীলালের বাড়িতে সব্জি বাগান পরিচর্যার কাজ করেন পাড়ার ছেলে শোভানন্দ এবং কয়েক জন। রাতে শশীলাল তাদের খাওয়ায়। সে সময় তারা মদ্যপানও করে বলে অভিযোগ। এর পরেই সব্জি বাগান নষ্ট করার অভিযোগে তারা কয়েক জন মিলে শ্যামলের উপর চড়াও হয়। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগ চিকিৎসা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সুজিত দাস বলেন, “মানসিক অসুস্থ ভবঘুরের ওপর অনেকেই নানা ধরনের অত্যাচার করে।” শ্যামলবাবুকে চিকিৎসা করিয়ে ভাল করতে পরিবারের তরফেও সচেষ্ট হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি। শিলিগুড়ির মনোবিদ সোমা ঘোষ বলেন, “মানসিক রোগীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার মধ্যে দিয়ে আনন্দ পাওয়ার এটা একটা প্রবণতা।” এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

অন্য বিষয়গুলি:

mental pataint
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy