গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
চিকিৎসকদের ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ নাম বদলে কি ‘চরক শপথ’ হতে চলেছে! বহু বছর ধরে চলে আসা চিকিৎসকদের শপথের নাম বদলের প্রাথমিক প্রস্তাব ঘিরে জন্ম নিয়েছে এই জল্পনা। গত সোমবার দেশের সব মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন। সেখানেই শপথের নাম বদলের প্রসঙ্গ উঠে আসে। যদিও এ নিয়ে চূড়ান্ত কোনও নির্দেশিকা এখনও পাঠানো হয়নি বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজ্যের এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ। তবে প্রাথমিক প্রস্তাবের কথা জানাজানি হতেই একাধিক চিকিৎসক এবং চিকিৎসক সংগঠন এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। পাশাপাশি চিকিৎসক শপথে ‘গৈরিকীকরণে’র বিষয়টিও উঠে আসছে।
চিকিৎসা পেশায় আসার আগে গোটা বিশ্বেই শপথ নেওয়ার প্রচলন রয়েছে। মূলত গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটসের নামাঙ্কিত শপথ পাঠ করা হয়। সেটাই ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ বা শপথ নামে পরিচিত। অপরদিকে প্রাচীন ভারতের চিকিৎসার ‘জনক’ বলে পরিচিত মহর্ষি চরক। প্রস্তাবে হিপোক্রেটের পরিবর্তে চরকের নাম ব্যবহারের প্রস্তাব উঠেছে।
এ নিয়ে ইন্ডিয়ান মেকিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি ও চিকিৎসক শান্তনু সেনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘‘শপথের নাম বদলের প্রস্তাব শোনার পর, আমি নিজে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের সদস্য হিসাবে চেয়ারম্যানেকে ফোন করেছিলাম , কিন্ত তিনি নিজেও এ ব্যাপারটা জানেন না। খোঁজ খবর নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। তবে শোনা যাচ্ছে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওঁকেও আমি ফোন করেছিলাম কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। সুতরাং এটা সত্য কি না তা যতক্ষণ না পুরোপুরি জানতে পারছি কিছু বলা উচিত নয়।’’ পাশাপাশি তিনি এও জানান, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে আর পাঁচটা চিকিৎসার সঙ্গে মিশিয়ে একটা ‘খিচুড়ি’ তৈরি করার চেষ্টা করছে কেন্দ্র সরকার। শান্তনুর কথায়,‘‘আয়ুর্বেদ, ইউনানি সব নিজের মতো বেড়ে উঠুক। কিন্তু শপথের নাম বদলের বিষয়টি সত্য হলে চিকিৎসক সমাজ বড় আন্দেলনে নামবে। এখানেও হিন্দুত্ববাদ ঢোকাতে চাওয়া হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় হিন্দু মেরুকরণের চেষ্টা হচ্ছে।’’
রাজ্য বিজেপি-র স্বাস্থ্য সেলের আহ্বায়ক এবং স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ অর্চনা মজুমদার বলেন,‘‘এই বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি আমার জানা নেই। তবে এটা বলতে পারি আমাদের দেশে ইংরেজ আমলেই আধুনিক চিকিৎসার বেশি প্রসার ঘটেছে। তারাই হিপোক্রেটিক ওথ শুরু করে। বর্তমানে আমাদের দেশ করোনা টিকা থেকে আধুনিক চিকিৎসায় নিজের জায়গা তৈরি করেছে। ভারতীয় কারও নামে শপথ নিলে তো ভালই হবে। কেন্দ্রীয় সরকার আয়ুর্বেদ-সহ ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতির চেষ্টা করছে। ‘আয়ূশ’ নামের সঙ্গেও ‘চরক শপথ’ ভাল মিলছে। এর মধ্যে দিয়ে যদি আমরা দেশপ্রেমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তাতে ভুলের কী আছে? দিনের শেষে মনে রাখতে হবে হিপোক্রেটস ভারতীয় ছিলেন না।’’
চরকের প্রায় কয়েকশো বছর আগে হিপোক্রেটস চিকিৎসাকে অন্ধ বিশ্বাস থেকে আলাদা করেছিলেন। আগে মানুষ রোগ থেকে জন্ম, মৃত্যু সব কিছুই ঈশ্বরের রাগ, সন্তুষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করা হতো। কিন্তু হিপোক্রেটস এই ধরনের চিন্তাকে বদলেনোর চেষ্টা করেছিলেন।
চিকিৎসক কুণাল সরকারের মতে,‘‘বিষয়টার মধ্যে জাতীয়তাবাদ বা অতিমাত্রায় দেশভক্তি থাকতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানের চিহ্ন নেই। সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশেও প্রচলিত এই শপথ। আধুনিক চিকিৎসার রাস্তা শুরু হয়েছে হিপোক্রেটসের মধ্যে দিয়ে। আমরা চরককে অসম্মান করছি না কিন্তু ইতিহাসকে অস্বীকার করি কী করে।’’ তাঁর মতে, এই অতিমারির সময় শপথের কী নাম হবে তার থেকেও বেশি প্রয়োজন দেশে সুষ্ঠু স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নে মন দেওয়া। এটা মূর্খামির পরিচয় দেওয়া হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
ডাক্তারি পাঠক্রমে ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ বাতিল করে চরকের শপথ চালু করার প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেছে রাজ্যের সার্ভিস ডাক্টর’স ফোরামও। ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস মনে করছেন, বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা কাঠামোয় আঘাত হানতে পারে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের পক্ষ থেকে চিকিৎসক কৌশিক লাহিড়ী বলেন, ‘‘হিপোক্রেটিক ওথের কোনও আইনি বৈধতা না থাকলেও সারা বিশ্বের চিকিৎসকরা এটা মানেন। চরক, শুশ্রুতকে অপমান না করেই বলছি করোনা অতিমারির মধ্যে শপথের নাম বদলের কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না।
শপথের নাম বিতর্কের মধ্যে অনেক চিকিৎসকই বলছেন যে, আগে কমিশনের মধ্যে এখনও যে অসম্পূর্ণ জায়গাগুলি থেকে গিয়েছে তার সমাধান আগে হওয়া উচিত। মাথায় রাখতে হবে, কমিশনে চিকিৎসকদের থেকে আমলাদেরই প্রভাব বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy