প্রণাম: কলকাতা বন্দরের ১৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ১০৫ বছরের নাগিনা ভগত। রবিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
কলকাতা বন্দর এ বার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে চিহ্নিত হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রবিবার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে বন্দরের ১৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে এই নামকরণের ঘোষণা করেন।
বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের কাছে শ্যামাপ্রসাদ ‘আদর্শ’। তিনি হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা। কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করার পরিপ্রেক্ষিতে মোদী সরকার শ্যামাপ্রসাদের ‘স্বপ্ন’ পূরণ হয়েছে বলে প্রচার করছে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এ দিনের বক্তৃতায় নেহরু মন্ত্রিসভায় দেশের প্রথম শিল্পমন্ত্রী হিসাবে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকার কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘দেশের প্রথম শিল্পনীতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন। চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ, দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন, সিন্দ্রি সার কারখানার মতো বহু প্রতিষ্ঠান তৈরি ও লগ্নি আনার কাজ তাঁর হাত দিয়েই শুরু হয়েছিল।’’ মোদী আরও বলেন, ‘‘এক দেশ, এক বিধান, এক নিশানের স্লোগান দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তাঁর নামে বন্দরের নামকরণ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।’’
শ্যামাপ্রসাদের নামে কলকাতা বন্দরের নামকরণ করা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক। নতুন নামের সাইনবোর্ড খুলে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। শ্যামাপ্রসাদকে ‘কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব’ বলে অভিহিত করেও বন্দরের এই নতুন নামকরণে অন্য প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল যুব কংগ্রেস সভাপতি ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে কলকাতা বন্দরের নামকরণে আপত্তি নেই। কিন্তু যুব দিবসে বন্দরের উন্নয়নের কথা ঘোষণা করলে যুবদের লাভ হত।’’ বাম এবং কংগ্রেস অবশ্য শ্যামাপ্রসাদের নামে কলকাতা বন্দরের নামকরণের সিদ্ধান্তকে তুলোধনা করেছে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে এবং মহান মাস্টারদার শহিদ দিবসে এই চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত বাংলার সমাজ এবং ইতিহাসের প্রতি চূড়ান্ত অশ্রদ্ধার পরিচয়।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের বক্তব্য, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে ভারতীয় যুবকদের অন্তর্ভুক্তিতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি হিন্দুদের জন্য আলাদা দেশের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যখন কংগ্রেস মুসলিম লিগকে প্রত্যাখ্যান করে, তখন তিনি লিগের সঙ্গে বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ রকম এক জন মানুষের নামে ঐতিহাসিক কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের নামকরণ করা হলে বাংলার ছাত্র-যুব সাইনবোর্ড সে দিনই খুলে দেবে।’’ শ্যামাপ্রসাদের নামে কলকাতা বন্দরের নামকরণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি দিয়েছে চারটি বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই, এআইএসএফ, পিএসইউ, এসবি।
আরও পড়ুন: পুরভোটের আগে পথেই নজর বাম-কংগ্রেসের
এ দিন কলকাতা বন্দরের অতীতের কথা বলতে গিয়ে বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে বন্দরের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান সরকারের ‘নিউ ইন্ডিয়া’র স্বপ্ন পূরণেও কলকাতা বন্দরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষ ভূমিকা নেবে বলে মনে করেন মোদী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পরবর্তী কালে দেশের শিল্প ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য নীতি প্রণেতা এবং বাংলার উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে আজীবন চলা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে কলকাতা বন্দরের নামকরণ করা হচ্ছে।’’
সাগরমালা প্রকল্পে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের প্রাপ্তি
• কলকাতা বন্দরের তিন নম্বর বার্থে যন্ত্রচালিত পণ্য খালাসের ব্যবস্থা
• হলদিয়া-বারাণসী জাতীয় জলপথে জাহাজ চলাচল শুরু করা
• হলদিয়ায় মাল্টিমোডাল টার্মিনাল (সড়ক, রেল ও জলপথ যোগাযোগের সুবিধা)
• হলদিয়ায় আরও একটি তরল পণ্যের টার্মিনাল তৈরি
• বন্দরের ১৫০ বছরের ইতিহাস নিয়ে মিউজ়িয়াম তৈরি
• গঙ্গাতীরের সৌন্দর্যায়ন
• কলকাতা বন্দরের ভিতরে সম্পূর্ণ রেক অপারেশন চালু
• বলাগড়ে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা
• ভারত-বাংলাদেশ প্রোটোকল রুট চালু
• রো-রো পরিষেবার মাধ্যমে পণ্য পরিবহণ
শ্যামাপ্রসাদের পাশাপাশি এ দিন কেন্দ্রীয় সরকারের গরিব কল্যাণের কর্মসূচিগুলির প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাবাসাহেব অম্বেডকরের কথা টেনে আনেন। তিনি বলেন, ‘‘দেশের জলসম্পদের বিকাশের প্রথম নীতি তৈরি করেছিলেন বাবাসাহেব। ১৯৪৪ সালে কলকাতাতেই জলসম্পদ বিকাশের নীতি তৈরির এক সম্মেলন হয়েছিল।’’ প্রধানমন্ত্রীর কথায়,‘‘দেশের জল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সেচ, বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাবাসাহেব ও শ্যামাপ্রসাদ মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন শাসকরা আর প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করেননি। ফলে তাঁদের নীতি, দূরদর্শিতা ও প্রকল্পগুলি থমকে গিয়েছিল।’’
২০১৪-র পর দেশের উন্নয়নে তাঁর সরকার নিরলস কাজ করে চলেছে বলে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশের বন্দরই হচ্ছে সমৃদ্ধির প্রবেশদ্বার। সে কথা মাথায় রেখে সাগরমালার মতো পরিকাঠামো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। পুরনো বন্দরগুলির আধুনিকীকরণ এবং নতুন বন্দর নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। মোদী বলেন, ‘‘সাগরমালায় ৫৭৫টি প্রকল্পে ৬ লক্ষ কোটি টাকার লগ্নি হবে। ২০০টি প্রকল্পে ৩ লক্ষ কোটি টাকার কাজ চলছে। ১২৫টি প্রকল্প ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে।’’
প্রধানমন্ত্রীর মতে, জলপথে বাণিজ্য বিস্তারে কলকাতার অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক দিকে সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ, অন্য দিকে নদীপথে দেশের উত্তরপূর্ব বা বেনারস পর্যন্ত ব্যবসা চালানোর সুযোগ কলকাতার হাতে রয়েছে। কলকাতা থেকে বেনারস ছোট জাহাজ ইতিমধ্যেউ চলতে শুরু করেছে। ২০২১ এর মধ্যে বড় জাহাজও যাতে চলতে পারে, সেই পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী এ দিন জানান।
এ ছাড়া ৩২ একর জমিতে গঙ্গাতীরের সৌন্দর্যায়ন, ক্রুজ ভেসেল চালানো, কোচি শিপইয়ার্ডের সঙ্গে নেতাজি সুভাষ ডকে জাহাজ মেরামতের কারখানা গড়া, কলকাতার ৩ নম্বর বার্থে যন্ত্রচালিত পণ্য খালাসের ব্যবস্থা করার মতো একগুচ্ছ প্রকল্পের সুচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। বন্দরের দু’জন শতায়ু পেরনো পেনশনভোগীকে সম্মানপ্রদান করেন মোদী। ১০৫ বছরের নাগিনা ভগত এবং ১০০ বছরের নরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর হাতে বন্দরের তরফে স্মারক-সামগ্রী তুলে দেন তিনি। পা ছুঁয়ে প্রণামও করেন। এলআইসি’র হাতে ৫০০ কোটির পেনশন তহবিলের চেক তুলে দেওয়া ছাড়া একগুচ্ছ প্রকল্পের ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে বন্দরের পেনশন তহবিলের সাড়ে তিন হাজার কোটির পুরো টাকাটাই বন্দর এলআইসি’র হাতে তুলে দিল। যা পেনশনভোগীদের আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে বলে জাহাজ মন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডব্য দাবি করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy