ভক্তদের খ্রিস্ট কীর্তন। —নিজস্ব চিত্র।
অগ্রহায়নের কনকনে সকালে গ্রামের পথে খোল-কর্তাল বাজিয়ে চলেছে কীর্তনের দল। প্রভাত কীর্তনের চেনা সুরে ঘুম ভাঙছে কুয়াশা মোড়া মালিয়াপোতা, পুঁটিমারি বা চাপড়ার। গাওয়া হচ্ছে পদ, কিন্তু শীত কুয়াশা ভেজা মেঠো পথে ঘুরে ঘুরে তাঁরা চেনা সুরে গাইছেনটা কী? রাধাকৃষ্ণ বা চৈতন্যকে নিয়ে প্রচলিত কোনও বৈষ্ণবীয় পদ কিংবা হরিনাম তো নয়। ভালো করে কান পাতলে শোনা যাবে ওই কীর্তনীয়ারা গাইছেন--পূরব গগনে দেখো গো চাহিয়ে, নবতারা উদয় হল/ জ্যোতির্বিদগনে নিরখি নয়নে, সেই তারার পিছে ধাইল। ‘লোফা’ একতালে বাঁধা, বিশুদ্ধ বাংলা কীর্তনের সুরে ওই ধরনের গান গোটা ডিসেম্বর জুড়ে শোনা যায় নদিয়ার বিভিন্ন খ্রিস্টান প্রধান এলাকায়। গানের কথা ছাড়া সব কিছুই কীর্তনের মতো বলে খ্রিস্টকীর্তন বা খ্রিস্টীয় কীর্তন নামেই এর পরিচিতি। কোথাও কোথাও যিশু কীর্তনও বলা হয়। শুধু বড়দিন বা ওই জাতীয় ধর্মীয় উৎসবেই নয়, জন্ম মৃত্যু বিয়ের মতো যে কোনও পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে নদিয়ার খ্রিস্টান ধর্মের মানুষ আয়োজন করে থাকেন খ্রিস্টীয় কীর্তনের, বলছিলেন চাপড়ার খ্রিস্টীয় কীর্তনের প্রবীণ গায়ক বাসু মণ্ডল।
বাসুবাবুর কথায়, “আমাদের পূর্বসূরিরাও ছিলেন নদিয়ার মানুষ। তাঁরা নবদ্বীপের কীর্তন শিখেছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁরা যখন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেন, তখন খ্রিস্ট ভজনার পদ্ধতিতে যুক্ত করলেন কীর্তনকে। সেই থেকেই এই খ্রিস্ট কীর্তনের প্রচলন। আমরা যে সব পদ এখন গাই, তার মধ্যে ১৭১০ সালে রচিত পদও রয়েছে। অর্থাৎ তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে খ্রিস্ট কীর্তনের পরম্পরা চলে আসছে। লালন ফকিরের গানেও খ্রিস্টের কথা আছে।”
তবে সময়ে সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলালেও খুব বেশি বদল ঘটেনি খ্রিস্ট কীর্তনের কথার। তিওট তালে বাঁধা কিবা শুভদিন এলো রে, ভবে হল সুপ্রচার / ঈশনন্দন যিশু ভবে হলেন অবতার, এই গান কবে থেকে গাওয়া হচ্ছে তার কোনও হিসাব নেই। বড়দিনের সময় নদিয়ার বিভিন্ন খ্রিস্টান অধ্যুষিত গ্রামে আরও একভাবে গাওয়া হয় যিশু কীর্তন। অনেকটা নাম সংকীর্তনের ঢঙে দু’অক্ষরের “যিশু যিশু” শব্দটিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেয়ে থাকেন গায়কেরা। দূর থেকে শুনলে বোঝার উপায় নেই, সেটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কীর্তন নয়। বড়দিন সহ যে কোনও খ্রিস্টীয় পরবের সময়ে খুব জনপ্রিয় এই যিশু কীর্তন। তবে এক্ষেত্রে বাংলা কীর্তনের প্রচলিত সুরের পাশাপাশি সমকালীন যে কোন জনপ্রিয় গানের সুরের বহুল ব্যবহার যিশু কীর্তনে শোনা যায়। বলছিলেন কৃষ্ণনগর মহাগির্জার ‘প্যারিস প্রিস্ট’ ফাদার পিটার।
ফাদার পিটারের কথায়, বড়দিনের বিখ্যাত ক্রিসমাস ক্যারলের বাংলা রূপান্তর বহু আগেই নদিয়ায় খ্রিস্টীয় কীর্তন নামে পরিচিতি লাভ করেছে। বড়দিনের ন’দিন আগে থেকে যিশুর জন্মোৎসবের প্রস্তুতি পালিত হয় ‘নভেনা’ বা বাংলায় ‘নবহ প্রার্থনা’ গানের মধ্যে দিয়ে। সেখানেও বাংলায় গাওয়া হয় আসবেন প্রভু আসবেন রাজা, এসো করি তাঁর পূজা। ফাদার পিটার বলেন, “১৬-২৪ ডিসেম্বর নভেনার সময়। ২৫শে রাত ঠিক বারোটার সময় প্রভু যিশুর জন্মের পর থেকে শুরু হয় ক্যারল। ক্যারল আসলে লাতিন শব্দ। তার থেকে কোরাস বা সমবেত কথাটি এসেছে।”
সারা বছর না হলেও বড়দিনের সময় খ্রিস্টীয় কীর্তন একটা আলাদা মাত্রা পায়। ২৫ এর আগে এবং পরেও চলতে থাকে যিশুর এই ভিন্ন স্বাদের ভজন সঙ্গীত। ফাদার পিটারের কথায়, “আমরা যেহেতু বাংলায় বাস করি তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই নভেনা এবং ক্যারল বাংলাতেই গাওয়া হয়। কারণ বাংলার মানুষ সঙ্গীত প্রিয় এবং সেই সঙ্গীত অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাংলার সুরের মাধ্যমে ভক্তদের ছোঁয়া যায়।”
চাপড়ার স্যামুয়েল মণ্ডল, হারান মাকাল, জনপ্রিয় লোকগায়ক সনজি মণ্ডল বা বাসু মণ্ডল খ্রিস্টীয় কীর্তনে সুপরিচিত নাম। বাসুবাবু বলেন, “খ্রিস্টীয় কীর্তন নদিয়ায় নিজস্ব সম্পদ। রানাঘাট, চাপড়ার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক দল আছে ওই কীর্তনের। তাঁরা খ্রিস্ট কীর্তনের মূল ধারাকে বজায় রেখে গানে কিছু কিছু নতুন পদের ব্যবহার করছেন। আসলে সময়, শ্রোতাদের চরিত্র সব বদলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে গানকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে তাকেও বদলাতে হবে। সেই কাজটা আমরা সাধ্য মতো করছি।” বাসুবাবুর নিজের রচনাঊর্ধ্বলোকে স্বর্গদূতে সুমধুর সঙ্গীত গায়/ মহিমা তাঁর স্বর্গপুরে, শান্তি এ ধরায়। তিনি বলেন, “বিয়ে বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও যিশু কীর্তন হয়। সেক্ষেত্রে স্থান কাল পাত্র অনুসারে গানের কথা বা সুরের ভিন্নতা আনতে হয়। কথার সঙ্গে বদলে যায় কীর্তনের প্রচলিত সুর। পরিবর্তে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নানা রাগ যেমন বেহাগ, জয়জয়ন্তী, ইমনে বাঁধা সেই গান।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy