গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বাংলাদেশের মেহেরপুর উপজেলার কাশারীবাজার থেকে এক সাংসদের ফোন এসেছিল সীমান্তবর্তী কাথুলিবাজার এলাকায় একটি বাড়িতে। দেশের পরিস্থিতি অশান্ত। তাই স্ত্রী এবং চার সন্তানকে নিয়ে কিছু দিনের জন্য দেশ ছেড়ে ভারতে ‘নিরাপদ আশ্রয়’ চান তিনি। ওই ফোনের কিছু ক্ষণ পরে কাথুলিবাজার থেকে ফোন আসে নদিয়ার করিমপুর-২ ব্লকের রাউতবাটি গ্রামে। মিনিট পাঁচেকের কথোপকথন। যিনি আশ্রয় চাইছেন, তাঁর ‘প্রোফাইল’, রাজনৈতিক ঝুঁকি, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি সংক্ষেপে জেনে নিয়ে চূড়ান্ত হয় রফা।
জানিয়ে দেওয়া হয়, ভারতে আসতে সাংসদের পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু খরচ পড়বে ভারতীয় মুদ্রায় এক লক্ষ করে টাকা। তা ছাড়া যত দিন ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ থাকবেন, তত দিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের নজর এড়িয়ে থাকার জন্য দিতে হবে মাসিক ১০ লক্ষ টাকা! খানিক দর কষাকষির পরে ঠিক হয় সীমান্ত পার করাতে দিতে হবে ১ লক্ষ নয়, মাথাপিছু ৭০ হাজার টাকা। আর আশ্রয়ের জন্য মাসিক ৫ লক্ষ। রাজি হয়ে যান সাংসদ। গত সোমবার রাতে মেহেরপুর সদর থেকে পরিবারকে নিয়ে রওনা দেন সাংসদ। বাংলাদেশের গ্রামে এক দিন অপেক্ষার পর গাঁটের কড়ি গুনে দিয়ে কাথুলি এবং কুলবেড়িয়া হয়ে ‘ফেন্সিংহীন’ বাংলার একটি গ্রামে পৌঁছে গিয়েছেন ওই সাংসদ ও তাঁর পরিবার। বাংলাদেশের মইনুদ্দিন (নাম পরিবর্তিত) এবং পশ্চিমবঙ্গের দেবাংশু (নাম পরিবর্তিত) মিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘অপারেশন’ সফল করেছেন।
বাংলাদেশের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এমন অবৈধ ভাবেই নাকি ভারতে আসছেন বাংলাদেশের ‘প্রভাবশালীরা’। তাঁদের নিরাপদে পৌঁছে দিতে কাজ করছে একাধিক চক্র। কেউ নিচ্ছে মাথাপিছু লক্ষ টাকা, কেউ ৫০ হাজার। বস্তুত, এই চক্র নিয়ে অবহিত বিএসএফ-ও। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতারও করেছে তারা। চলছে আরও সুলুকসন্ধান।
পড়শি দেশের অশান্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তৈরি হয়েছে অবৈধ ভাবে সীমান্ত পেরোনোর নতুন ‘সিন্ডিকেট’। পারাপার এবং আশ্রয়ের জন্য কেউ খরচ করছেন ২ হাজার টাকা (তাঁরা বেশি দিন থাকছেন না), কাউকে দিতে হচ্ছে ২ লক্ষ টাকা (বেশি দিন থাকার জন্য)। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর্থিক সঙ্গতি এবং সামাজিক পরিচিতি বুঝেই টাকা চাওয়া এবং নেওয়া হচ্ছে। কাথুলিবাজার এলাকায় ব্যবসা করেন শেখ নাজিম (নাম পরিবর্তিত)। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা এ সব এলাকা হাতের তালুর মতো চিনি। কোথায় কাঁটাতার আছে, কোথায় নেই, সব মুখস্থ। কোথায় পাচারকারী কাঁটাতার কেটে রেখেছে, সেটাও জানি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এই বর্ষায় ভৈরব নদী টইটম্বুর। নদী পুরো খোলা। এ দেশ থেকে যারা ও দেশে (ভারতে) যেতে চাইছে, পরিচিত আর আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে শুধু সীমান্ত পার করিয়ে দিচ্ছি আমরা। বাকি দায়িত্ব ওদের।’’
পারাপার করাতে কে কত নিচ্ছেন? ব্যবসায়ীর স্বীকারোক্তি, ‘‘ঝুঁকি দু’পক্ষেরই রয়েছে। তাই টাকার ভাগাভাগিও সমান সমান।’’ এ পারের দেবাংশু বললেন, ‘‘কাঁটাতার পার হয়ে আমাদের চাষের জমি আছে। রোজ যাতায়াত করি। ও দিক থেকে বেশ কয়েক জন পরিচিত, আত্মীয়স্বজনেরা ভারতে আসার জন্য মোটা টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা শুধু পার করে এখানে নিয়ে এসেছি। রাখার দায়িত্ব আমাদের নয়। সেটা দেখে অন্য লোক।’’
বিএসএফ, পুলিশের নজর এড়াচ্ছেন কী ভাবে? দেবাংশুর জবাব, ‘‘বিএসএফ এখন খুব সজাগ। সেটা ঠিক। তবে গ্রামে আমাদের সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক। তাই কাউকে আশ্রয় দিয়েছি জানলে কেউ মুখ খুলবে না।’’ কিন্তু কাজটা তো অনৈতিক? যুবক এ বার দার্শনিক, ‘‘ও দেশ থেকে যারা আসছে, তারা তো সত্যিই বিপদে পড়েছে। বিপদে মানুষকে আশ্রয় দেওয়া তো মানুষেরই কর্তব্য!’’
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ‘ঘনিষ্ঠ’ বা সমর্থকেরা এখন বাংলাদেশের আন্দোলনকারীদের নজরে। হাসিনার আমলের অনেক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় লুক-আউট নোটিস দিয়েছে সে দেশের প্রশাসন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, এমন মানুষজনের ক্ষেত্রেও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দেশ ছাড়ার অনুমতি দিচ্ছে না বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ নজরদারি চালানো হচ্ছে। তার পরেও অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই যে কোনও ভাবে দেশ ছেড়ে আপাতত এ পারে ঠাঁই নিতে চাইছেন। সেখান থেকেই এই ‘দালাল নির্ভরতা’।
তবে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামে এই ‘হঠাৎ অতিথিদের’ নিয়ে শঙ্কিত স্থানীয় বাসিন্দারা। যদিও ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না। ‘নতুন পন্থায়’ অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে বিএসএফ-ও উদ্বিগ্ন। সিন্ডিকেট চক্রের উপস্থিতি টের পেয়ে টহলদারি বেড়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায়। বিএসএফ দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি একে আর্য বলেন, ‘‘পড়শি দেশের অশান্ত পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় টহল কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলির বাসিন্দাদের সঙ্গে জনসংযোগ বৃদ্ধি করেছি আমরা। অনুপ্রবেশের সব রকম খবর রাখার চেষ্টায় বিএসএফ। বেশ কয়েকটি অবৈধ অনুপ্রবেশ আটকেও দিয়েছেন জওয়ানেরা। গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তবে সীমান্ত এলাকায় এই মুহূর্তে কোনও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির খবর নেই।’’ অবৈধ অনুপ্রবেশ আটকাতে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (বিজিবি) কতটা সক্রিয়? বিজিবি-র মহা-উপ পরিচালক (যোগাযোগ) কর্নেল শফিউল আলম পারভেজ আনন্দবাজার অনলাইনকে ঢাকা থেকে বলেন, ‘‘যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেআইনি এবং অন্যায় কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তেরা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ও দেশে যাতে কোনও ভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় না পায়, তার জন্য আমরা ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy