গৌরাঙ্গিনী মাতা। নদিয়ার নবদ্বীপ। ছবি : সুদীপ ভট্টাচার্য।
পদকর্তা লিখেছেন, ‘‘অঙ্গনা মঙ্গনা মন্তরা মাধবম। মাধবম মাধবম চান্তরেণ অঙ্গনা।। ইত্থমা কল্পীতে মণ্ডলী মধ্যে গো। বেণুনাং সংযগৌ দেবকী নন্দন।।’’শারদ পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনে যমুনার তীরে (মতান্তরে রৈবতকে) ব্রজগোপীদের সঙ্গে রাস নৃত্যে মেতেছেন মাধব। ভাগবতপুরাণ অনুসারে ব্রজগোপীদের বিশুদ্ধ ভক্তিতে তুষ্ট পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণচাঁদের রাতে ব্রজগোপীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দ প্রদান করেন। ‘রাস’ শব্দের আভিধানিক অর্থই হল নারী-পুরুষের মণ্ডলাকার নৃত্য। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে যাকে ‘হল্লীষক্’ নৃত্য বলা হয়েছে। এক পুরুষ নর্তককে কেন্দ্র করে বহু নর্তকীর হল্লীষক্ নৃত্যের সঙ্গে তাল যুক্ত হলেই তা হয়ে যায় ‘রাসক’। যা থেকে রাস কথাটির উদ্ভব। তাই বৈষ্ণবদের কাছে রাস ভিন্ন ব্যাঞ্জনা বহন করে। ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব হল রাস।
‘রস’ থেকেই রাস তথা আনন্দ। উপনিষদ বলছে, রসো বৈ সঃ, ব্রহ্ম রস ছাড়া কিছুই নয়। বৈষ্ণবদর্শন মতে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হলেন সেই রসের ঘনীভূত আধার। হেমন্তের ভেজা জ্যোৎস্নায় রাসের উদ্যাপনে তারই অনুসরণ। কার্তিক পূর্ণিমার এ রাত বৈষ্ণবদের বড় প্রিয়।তবে চৈতন্যধাম নবদ্বীপে যে রাস দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে মানুষ সেই রাসের সংজ্ঞা, উপস্থাপনা সবই বিপরীত। মঠমন্দিরের নৃত্যময়, সঙ্গীত মেদুর রাসের পরিবর্তে এখানে পূর্ণিমার ভরা রাতে তন্ত্রমতে অসংখ্য শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো। এবং তাকে ঘিরে আদ্যন্ত তামসিকতায় ভরা এক উৎসবের দামাল উদ্যাপন। চুম্বকে এই নবদ্বীপের রাস।
বৈষ্ণবদের গুপ্ত বৃন্দাবন নবদ্বীপে এমন বিপ্রতীপ ধারার ‘শাক্ত রাসের’ উদ্ভব এবং বাড়বাড়ন্ত কবে থেকে, কেনই বা হল? অনিবার্য এই প্রশ্নের উত্তরে অসংখ্য মতামত ঘুরে বেড়ায়। যার অধিকাংশই ভিত্তিহীন, মনগড়া গল্পে ঠাসা। আপনমনের মাধুরী মিশায়ে যে যেমন খুশি ভাবে গড়ে নিয়েছেন নবদ্বীপের রাস বদলের কাহিনি। তোয়াক্কা করেননি যুক্তি প্রমাণের। সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যাটি হল বৈষ্ণবদের শায়েস্তা করতে নদিয়ারাজ শাক্ত রাসের প্রচলন করেন। কোনও সন্দেহ নেই নবদ্বীপ রাসের বৈষ্ণবীয় চরিত্র বদলে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সচেতন ভূমিকা ছিল। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব মনে করেন ‘‘১৭৫২ থেকে ১৭৫৬ সালের মধ্যবর্তী কোনও সময়ে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, বারোদোল এবং নবদ্বীপের রাসের সূচনা করে ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়।’’বারোদোলের মতো আদ্যোপান্ত বৈষ্ণবীয় উৎসবের যিনি প্রচলন করেন তিনি আর যাই হোক বৈষ্ণববিদ্বেষী নন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শক্তির উপাসক কৃষ্ণচন্দ্র মনেপ্রাণে চাইতেন তার রাজত্বে শুদ্ধাচারে শক্তিসাধনা হোক। তাই তিনি রাস পূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপে শক্তি পুজোয় উৎসাহ দেওয়া শুরু করেন। রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy