ক্লাসে পার্বতী পাল ও পুষ্প দাস। নিজস্ব চিত্র
কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি পুতুলপট্টির মুখে বিরাট শিমূল গাছটার গা ঘেঁষে সোজা এগোলে ডান দিকে পড়বে স্কুলটি।
বই হাতে চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছিলেন পার্বতী পাল। একটু দূরে তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে পড়া ধরছিলেন পুষ্প দাস। ঘরের একদম শেষ মাথায় রান্না হচ্ছে মিড-ডে মিল। পার্বতীর হাতে হাতপাখা। স্কুলে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় আলো-পাখা কিছুই নেই। গরমে পড়ুয়াদের খুব কষ্ট।
১৯৭৪ সাল। এলাকায় কোনও প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। এলাকার কিছু মানুষ চাইছিলেন একটা স্কুল হোক। টিনের চালা ঘরে শুরু হয় স্কুল। নাম দাসপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বিএ পাশ করে পার্বতী তখন বাড়িতেই। তাঁকে বলা হল স্কুলে পড়াতে। স্কুলের হাতে টাকা নেই, পড়াতে হবে বিনা পারিশ্রমিকেই। সব জেনেও ছোটদের পড়াতে রাজি হয়ে যান পার্বতী।
এর কিছু দিন পরে চার্চের সহায়তায় পাকা বাড়ি হয় স্কুলের। সেই বাড়িতেই আজ স্কুল চলছে। সরকারি অনুমোদন পায়নি স্কুল। ফলে, বই বা কোনও সরকারি সাহায্য কিছুই মিলত না।
‘‘আমরা তখন বিভিন্ন স্কুল ঘুরে, বছর শেষে পড়ুয়াদের ফেরত দেওয়া পুরনো বই থেকে বেছে একটু ভাল বই নিয়ে আসতাম স্কুলের জন্য’’— বলেন পার্বতী। স্কুল-অন্ত প্রাণ
পার্বতী স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকায়
বিয়েও করেননি।
১৯৭৬ সালে এই এলাকায় বিয়ে হয়ে আসেন বর্ধমানের মেয়ে পুষ্প দাস। স্বামী পিডব্লুডি অফিসে রোলার চালাতেন। মাধ্যমিক পাস পুষ্প ওই স্কুলে হয়ে যান বিনা পারিশ্রমিকের দিদিমণি। ছাত্রছাত্রী তখন প্রায় দু’শো। পুষ্প বলেন, ‘‘এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে নাম এসেছে ক’বার। কিন্তু স্কুল ফেলে চলে যাব, ভাবতে পারতাম না। তাই বার বার চাকরি করতে অনিচ্ছুকে টিক দিতাম।’’
১৯৮২ সালে চার্চ থেকে পূরবী মণ্ডলকে পাঠানো হয়। তিনি ২০০৭ সাল পর্যন্ত স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আর ১৯৮৪ সালে দিদিমণি হয়ে স্কুলে যোগ দেন বিএ-জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং পাশ করা শিখা বাগচী।
কিন্তু শুধু আবেগ দিয়ে তো আর স্কুল চলে না। সরকারি অনুমোদন নেই। টাকা নেই। শিক্ষিকাদের মাইনে নেই। কোনও ধরনের সরকারি সাহায্য নেই। অবস্থায় ২০০৭ সালে স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে কৃষ্ণনগরের তৎকালীন পুরপ্রধান উদয় মিত্রের সহযোগিতায় স্কুলকে শিশুশ্রমিক বিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়। এর ফলে নিয়মের মধ্যে পড়ে যায় স্কুল। বলা হয়, ৫০ জনের বেশি পড়ুয়া মিড-ডে মিল পাবে না। প্রয়োজনীয় শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে পুরনো দিদিমণিদের থেকে দু’জনকে নেওয়া হবে। স্কুল বাঁচাতে মেনে নেওয়া হয় সব শর্ত। পার্বতী হন শিক্ষিকা। পুষ্প নিযুক্ত হন সহকারি পদে। শিখা আগের মতোই স্বেচ্ছাশ্রম দিতে থাকেন। এই সময়ে দু’জনের সামান্য যে বেতন মিলত, তা তিন জনে ভাগ করে নিতেন। পড়ুয়াও ৫০ জনের কিছু বেশি থাকায় বরাদ্দ মিড-ডে মিল ভাগ করে দেওয়া হত। পরে রাঁধুনি পদে বিএ পাস করা শিখাকে নিয়োগ করা হয়।
নামে তিন জনের তিনটি আলাদা পদ হলেও সকলেই ছাত্র পড়ান স্কুলে। সব কাজ ভাগ করে নেন। বর্তমানে ওই স্কুলে মোট শিক্ষাকর্মী ৭ জন। রাঁধুনি বাদে বাকিরা শেষ বেতন পেয়েছেন ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৫ মাসের বেতন বাকি।
পুষ্প বলেন, ‘‘বিনা পারিশ্রমিকে পড়িয়েছি বহু বছর। বেতন পাই আর না পাই— জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই স্কুলে পড়িয়ে যেতে চাই।’’
বেতন নয়, বাকি জীবনটা যেন স্কুলে পড়িয়েই কাটে, এটুকুই চান স্কুলের দিদিমণিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy