দু’দিন ধরে অভিযান চালিয়ে নদিয়ার বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় মোট চারটি বাঙ্কার পায় বিএসএফ। —নিজস্ব চিত্র।
বৈশাখী পূর্ণিমায় সাত দিন ধরে হরিনাম সঙ্কীর্তন হয়েছিল। নেমন্তন্ন ছিল আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের। প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে লাগানো হয়েছিল লাউডস্পিকার এবং ডিজে বক্স। কপালে তিলক, গলায় তুলসীকাঠির মালা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করেছিলেন আয়োজক লাল্টু মহারাজ। সে বার যেখানে প্যান্ডেল খাটানো হয়েছিল, তার অনতিদূরে কয়েক দিন আগে মিলেছে চারটি বাঙ্কার। ওই বাঙ্কারগুলো তখনই বসানো হয়েছিল। আর এলাকাবাসীর নজর ঘোরাতেই সঙ্কীর্তনের ‘মেগা আয়োজন’ হয়েছিল বলে মনে করছেন নিষিদ্ধ সিরাপ উদ্ধার মামলার তদন্তকারীরা।
গত শুক্রবার নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানা এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বিঘা দুয়েকের আমবাগান থেকে চারটি বাঙ্কার উদ্ধার করে বিএসএফ। বাঙ্কারে পাওয়া যায় প্রায় সাড়ে নয় কোটি টাকার ফেনসিডিল। পরে মামলাটির তদন্তভার নেয় নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরো (মাদক নিয়ন্ত্রক সংস্থা)। খোঁজ শুরু হয় বাগানের মালিকের। এখনও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, মাদক মামলায় দীর্ঘ চার বছর জেলবন্দি ছিলেন ‘মহারাজ’। সেই সময়ে তাঁর আইনি লড়াইয়ের খরচ জুগিয়েছিলেন ভিন্জেলার এক প্রভাবশালী মাদক পাচারকারী। জেল খেটে এসে তিলক, তুলসীর মালা আর ফতুয়ায় নতুন অবতারে হাজির হন ‘লাল বাবা’ ওরফে ‘লাল্টু মহারাজ’। অনেকে বলছেন, লাল্টু মহারাজের আসল নাম সুশান্ত ঘোষ। স্থানীয় সূত্রের খবর, গত বৈশাখ মাসে নামযজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন লাল্টু। কীর্তন শুনতে আসা প্রত্যেককে গীতা উপহার দেন তিনি।
বসতি অঞ্চল থেকে কিছুটা দূরে যে জমিতে কীর্তনের আসর বসেছিল, সেখানেই চারটি বাঙ্কার মেলা নিয়ে নানা জনের নানা মত। তদন্তকারীদের একটি সূত্রের খবর, সেই সময়ে বাইরের অনেকেই এসেছিলেন। তাঁদের নিয়ে স্থানীয়দেরও মনে সন্দেহের অবকাশ হয়নি। তবে ওই অপরিচিত মুখের ভিড়ে বহিরাগত দক্ষ মিস্ত্রিরাও ছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। তদন্তকারীরা এ-ও বলছেন, কীর্তনের সাত দিনের মধ্যেই মাটি খোঁড়ার যন্ত্র, গ্যাস কাটার ইত্যাদি আনা হয়েছিল। তার কিছু দিন পরে আমবাগানের ঝুপড়িঘর গড়ে ওঠে। লোকজন থাকতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ওই ধর্মকর্মের আড়ালে লাল্টু যে এমন নিষিদ্ধ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তা কেউই ঠাওর করতে পারেননি।
রসরাজ গোঁসাই নামে এলাকার প্রবীণ এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘বাবার (লাল্টু মহারাজ) বাড়িতে সাত দিন ধরে মহানাম যজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল। এত বড় অনুষ্ঠান এই অঞ্চলে আগে হয়নি। সাত দিন নরনারায়ণ সেবা, দানধ্যান, সব মিলিয়ে অবাক করার মতো আয়োজন হয়েছিল।’’ তবে ‘বাবা’ খারাপ কোনও কাজে জড়িত, তা বিশ্বাস করতে চান না বৃদ্ধ। ওই গ্রামের আর এক বাসিন্দা মথুরা ঘোষ বলেন, ‘‘তখন এত লাউডস্পিকার আর বক্স বেজেছিল যে, বাড়ির ভিতরে নিজেরা নিজেদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। এলাকায় তো কাক-চিল বসতে পারেনি। এখন কত কিছুই শুনছি।’’ তদন্তকারীদের একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, পরিকল্পনা করে গ্রামের মানুষদের মহানাম যজ্ঞে মাতিয়ে রেখে লোকচক্ষুর আড়ালে বড় অপারেশন চালিয়েছিলেন ‘মহারাজ’। তাঁর ওই ব্যবসায় সাহায্য করেছিলেন গিরি, পঙ্কু-সহ জনা কয়েক স্থানীয় যুবক। লাল্টুর দৌলতে তাঁদের পকেটের হাল ভাল হয়েছে। এ-ও জানা যাচ্ছে, ডোঙাঘাট, পুট্টিখালি, ভাজনঘাট, ধরমপুর-সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজের খোঁজে থাকা বেকার ছেলেদের মোটা টাকা আয়ের লোভ দেখিয়ে মাদক সিন্ডিকেটে যোগদান করানো হত। মূলত মাদক হস্তান্তরের কাজ করতেন তাঁরা। ২০১৬ থেকে ’১৮ সাল নাগাদ কৃষ্ণগঞ্জ-সহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে। সকলেই কি ‘মহারাজ’-এর সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত? উত্তর খুঁজছেন তদন্তকারীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy