বহরমপুরের সতীমার গলিটা একটুও বদলায়নি।
গলিটাকে সাপের মতো পেঁচিয়ে রেখেছে ডজন খানেক ডজনখানেক আবাসন। একটু ময়লা হয়ে যাওয়া দেওয়াল আর ভাঙা পাঁচিলের ‘আশাবরি’ তারই একটা।
গলির মুখে চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করলে ছেলেটি এগিয়ে এসে হাত তুলে দেকিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘ওই যে বাড়িগুলো দেখছেন, গিয়ে বলবেন যে বাড়িতে খুন হয়েছিল...সব্বাই দেখিয়ে দেবে।’’ এটাই এখন আশাবরীর পরিচিতি।
সেই আবাসনের এক তলার ফ্ল্যাটে তিন মহিলার বসত, ছিল— জীবন বিমার এজেন্ট বিজয়া বসু, তাঁর মেয়ে আত্রেয়ী আর তাঁর বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়া পিসিমা প্রভা দাস।
বিজয়াদেবীর বড়দি প্রৌঢ়া ইরা মিত্র সপরিবার থাকেন সতীমার গলি থেকে আড়াই কিলোমিটার উত্তরে খাগড়া লেঠেল মণ্ডপ এলাকায়। যিনি একটু পরেই বলবেন, ‘‘পিসি, বোন ও বোনঝির টানে ওই পথটুকু রোজ ভাঙতাম।’’
সেই রোববার সকালে তিনিই বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেখেছিলেন বাইরে তালা ঝুলছে। রবিবার তো বটেই, পরের দিন সোমবার দিনভর মোবাইলে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। বিজয়াদের সব ক’টি মোবাইল ফোনই কেতাবি গলায় বলে এসেছে সুইচ অফ।
তৃতীয় দিনে ভাঙা হয়েছিল দরজা। পুলিশ দেখেছিল বোন ও বোনঝির দেহ পড়ে রয়েছে শোয়ার ঘরে। ইরা বলছেন, ‘‘পিসিমনির দেহটা পাশের ঘরে, আর দেখতে পারিনি, আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।’’
২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি। তদন্তে নেমে পুলিশ জানিয়েছিল— খুন এবং তা হয়েছে অন্তত দু’দিন আগে। পাশের ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছিল একটা প্যাকেট। নাম-ঠিকানাহীন সেই সাদা প্যাকেটে মিলেছিল ৬’টা সন্দেশ। কিন্তু থাকার তো কথা দশটা? সন্দেহটা দানা বেঁধেছিল সেখান থেকেই। বাকি চারটে কে খেল?
খুনের কিনারা করতে পুলিশের হাতে ‘ক্লু’ বলতে ছিল ওইটুকুই। ময়নাতদন্তের পর পুলিশ জানতে পারে, ওই মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়নি। তদন্তের গতিমুখ ঘোরাতে খুনের পরে মা-মেয়েকে বিবস্ত্র করা হয়েছে। বিজয়াদেবী ও মেয়ে আত্রেয়ীর কানে ও গলায় থাকা সোনার গয়নাও পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি তিন মহিলার তিনটি মোবাইলও।
কলকাতা থেকে উজিয়ে আসা সিআইডি’র গোয়েন্দারা ভ্রূ কুঁচকে খানিক ঘোরাঘুরি, আঙুলের ছাপ, পুলিশ কুকুর— বাদ যায়নি কিছুই।
বিজয়াদেবীর স্বামী দেবাশিস বসু পুরীতে একটি বেসরকারি হোটেলে ম্যানেজার। খুনের ব্যাপারে বিজয়াদেবীর দিদি ইরাদেবী দেবাশিসবাবুর দিকে সন্দেহের আঙুল তুলেছিলেন বটে কিন্তু জেরা করে পুলিশ তেমন কিছু পায়নি। তাহলে?
তবে পেয়েছিল বটে একটা তথ্য। পুলিশের জেরায় তিনি জানিয়েছিলেন — ‘‘কয়েক দিন আগে পয়লা জানুয়ারি মা-মেয়ের সঙ্গে ফোনে আমার কথা হয়েছে। কয়েক দিন আগে তারা এক জ্যোতিষীর কাছে ভাগ্যগণনা করিয়েছে। তাদের ‘কালসর্প দোষ’ হয়েছে বলে জ্যোতিষী জনিয়েছে। সেই দোষ কাটাতে জ্যোতিষী ৫ হাজার টাকা চেয়েছে।’’
সেই সূত্র ধরেই এগোতে তাকে পুলিশ। জানাতে পারে, জ্যোতিষীর নাম নিত্যানন্দ দাস ওরফে নিত্যানন্দ ভারতী। নিবাস বহরমপুর শহর লাগোয়া পাকুড়িয়া এলাকায়, ভাড়া বাড়িতে। পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার পর দিন ৫ জানুয়ারি রবিবার থেকে নিত্যানন্দ বেপাত্তা। আত্রেয়ীদের ৩টি মোবাইলের সুইচ অফ থাকলেও নিত্যানন্দের মোবাইল ফোন কিন্তু চালু ছিল। সেই সূত্র ধরে বহরমপুর থানার পুলিশ ২০১৪ সালের ১০ জানুয়ারি শিলিগুড়ি পৌঁছয়। সেখানে এক হোটেল থেকে নিত্যানন্দকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
জেরায় সেই জ্যোতিষী কবুল করেন, ‘‘তন্ত্রসাধনার জন্য ঘটনার দিন সন্ধ্যায় বিজয়াদেবীকে নিয়ে সে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে চাল-কলা-দুধ-সন্দেশের সঙ্গেই ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলাম।’’ বাকিদেরও অচেতন করা হয়েছিল একই ভাবে। কিছু ক্ষণের মধ্যে তাঁরা তিন জনেই অচেতন হয়ে পড়েন। একটু পরেই অবশ্য জ্ঞান ফিরে এসেছিল প্রভাদেবীর। গলা টিপে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় তাঁকেও। কিন্তু ততক্ষণে আবাসনের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে নৈশপ্রহরী ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফলে নিত্যানন্দকে সারারাত মৃতদেহ গুলির পাশে বসেই কাটাতে হয়। পরদিন ভোরে প্রধান ফটক খোলা হতেই নিত্যানন্দ চম্পট দেয়। সামান্য ওই সোনায় গয়নার জন্য তিন-তিনটি খুন?
সে উত্তরটা অবশ্য এখনও মেলেনি। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy