কালীপুজোর বিসর্জনে খুন হয়ে যাওয়া তুহিনশুভ্র বসু। ফাইল চিত্র।
বাবার মৃতদেহ শোয়ানো ছিল দরজার ঠিক সামনে। শেষ বারের মত ছেলেকে বাবার মুখ দেখানোর জন্য সাদা কাপড় খনিক সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই মুখে আলতো করে হাত বুলিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল ন’বছরের ছেলে সপ্তর্ষি। ওই শেষ বারের মতো। তার পর থেকে গত এক বছরে সে আর কাঁদেনি। তবে যত দিন যাচ্ছে, কিশোর কেমন যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ঘরের কোণে একা একাই থাকতে পছন্দ করে। কথাবার্তা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। স্কুলে যেতে চায় না। মাঝে মাঝে বলে, স্কুলে গেলে তাকেও বাবার মতো মেরে ফেলা হবে! বাবার মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে শৈশব।
গত বছর ঠিক কালীপুজোর ভাসানের দিনেই ওই কিশোরের বাবা তুহিনশুভ্র বসুকে কুপিয়ে খুন করেছিল দুষ্কৃতীরা। প্রতি বছরের মতো পাড়ার ক্লাবের কালীপ্রতিমা বিসর্জনে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল নিরীহ মানুষটা। দমকল বাহিনীতে চাকরি করতেন তুহিনশুভ্র। সে দিন ছুটি নেন পাড়ার ক্লাবের প্রতিমার সঙ্গে বেরবেন বলে। পর দিন বিকেলে বাড়ি ফিরলেন মৃতদেহ হয়ে। লাশকাটা ঘরে তাঁর শরীর কাটাছেঁড়া করে ময়নাতদন্ত হয়। তার পরে সেই শরীর বাড়ির দরজার সামনে রেখে দেওয়া হয়। স্থির চোখে বাবার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ছিল ছোট্ট সপ্তর্ষি।
আচমকা বাবার মৃত্যু কিশোর-মনে প্রবল অভিঘাত তৈরি করে দিয়েছে। এলোমেলো করে দিয়েছে তার কৈশোরের স্বাভাবিক আনন্দ। যে কালীপুজো, দীপাবলিতে তার আলোর উৎসবে মেতে ওঠার কথা, সেই সময়ে ছেলেটি ভয়ে-আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকে সারা ক্ষণ। মাঝেমধ্যেই মাকে বলে, “এখান থেকে আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। না হলে ওরা বাবার মতো আমাকেও মেরে ফেলবে।”
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে অসহায় চোখের জল ফেলেন মা মৌসুমী বসু। শান্ত, মিষ্টি স্বভাবের ছেলেটা বদলে যাচ্ছে। রেগে যায়, একটুতেই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। কিশোরকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার এক মনো-চিকিৎসকের কাছে। কাউন্সিলিং চলছে। কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা মৌসুমী। বলেন, “বাবা ছিল ও সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সারা ক্ষণ বাবার সঙ্গে লেগে থাকত। যে দিন মানুষটা খুন হল, সে দিনও সন্ধ্যায় দু’জনে মিলে বাজি পুড়িয়েছিল।” জানান, কিছু বাজি তুহিনশুভ্র রেখে দিয়েছিলেন জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য। এখনও রাখা আছে সেই ভাবে। বাবার মৃত্যুর পর থেকে আর বাজিতে হাত দেয়নি ছোট্ট সপ্তর্ষি।
সোমবার ছিল তুহিনশুভ্রের বাৎসরিক ক্রিয়াদি। ঘরের একটা কোণে মেঝের উপরে তার জোগাড় করে রাখা হয়েছে। সে দিকে তাকিয়ে থাকেন মৃতের বৃদ্ধা মা লিপিকা বসু। শাড়ির খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, “কৃষ্ণনগরের মানুষের কাছে আমার একটাই অনুরোধ। আমার মতো আর কোনও মায়ের কোল খালি করে দেবেন না। কোনও সন্তানকে তার বাবা-হারা করবেন না।”
মনো-চিকিৎসক সপ্তর্ষিকে কোনও বিষয়ে জোর করায় বারণ করেছেন। কালী ঠাকুর দেখতে বেরোয়নি কিশোর। কেউ জোরও করেনি। কিশোর শুধু এক বার মাকে কানে-কানে বলেছে, “বাবা থাকলে আজ রেস্তরাঁয় খেতে নিয়ে যেত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy