লালগোলার রথ যাত্রা। —ফাইল চিত্র।
লালগোলা একটি প্রাচীন জনপদ। পদ্মা,গঙ্গা ও ভৈরব- এই তিন নদী বিধৌত শ্যামল বনানী ঘেরা স্থানের রথযাত্রা বাংলার কয়েকটি বিখ্যাত রথযাত্রা ও রথের মেলার মধ্যে প্রসিদ্ধ। আজ থেকে ২০০ বছর আগে এর সূচনা হয়।
উত্তরপ্রদেশের গাজিপুর জেলার পালীগ্রাম থেকে মহিমা রায় নামে এক জনৈক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তি পদ্মার পূর্বে অবস্থিত সুন্দরপুর (বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ থানার অধীন) গ্রামে এসে বাস করতে শুরু করেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি কোনও সম্পত্তি রেখে যেতে পারেননি, তবে দুই তেজস্বী পুত্রকে রেখে যান। সুন্দরপুর গ্রাম পদ্মার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দলেল রায় ও রাজনাথ রায় যখন পদ্মার অপর পারে মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা গ্রামে বাসা বাঁধলেন, লালগোলা তখন নিবিড় জঙ্গলে ঢাকা। লোকবসতি সামান্য, ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ নেই কিন্তু এই ভাগ্য বিপর্যয়ের মাঝেই লুকিয়ে ছিল দলেল রায়ের ভাগ্যোন্মেষ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে তখন অশান্তির কালো মেঘ। সেই কালো মেঘ থেকে বজ্রাঘাত হল মুর্শিদাবাদ নবাব বংশে, অন্যদিকে একই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ল লালগোলা রাজ পরিবারের উপর। এই মেঘের অবিরাম বর্ষণ রাজ পরিবারের অঙ্কুরকে মহীরুহ করে তুলল। বাংলার রাষ্ট্র বিপ্লবের সঙ্গে দলেল রায়ের সৌভাগ্য শুরু হয়। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে নবাব সরফরাজ খাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে আলিবর্দী খাঁকে বাংলার মসনদে বসানোর যে ঘৃণিত ষড়যন্ত্র চলছিল তার ক্লাইম্যাক্স লেখা হয় গিরিয়ার যুদ্ধে। আলিবর্দী আজিমাবাদ থেকে সুতিতে এসে উপস্থিত হলে নবাব সরফরাজ খাঁ
লালগোলার দেওয়ানসরাইয়ে শিবির স্থাপন করেন। মুর্শিদাবাদ থেকে নবাব নির্মিত রাজপথ দেওয়ানসরাইয়ের বুক চিরে চলে গিয়েছে উত্তর-দক্ষিণে। সেসময় এটিই নবাবদের যাতায়াতের মুখ্য পথের একটি ছিল। এ বিষয়ে একটি গ্রাম্য কবিতা রয়েছে- ‘নবাবের তাম্বু পড়িল ব্রাহ্মণের স্থলে/ আলিবর্দির তাম্বু তখন পড়িল রাজমহলে।/ নবাবের তাম্বু যখন পড়িল দেওয়ানসরাই,/ আলিবর্দির তখন আইল ফারাক্কায়।’ সেসময় দলেল রায় বহু উপঢৌকন নিয়ে নবাবের শিবিরে উপস্থিত হন। নবাব তাঁর অনেক সদগুণ লক্ষ্য করে তাঁকে জিলাদারীর (জলপথে শান্তি রক্ষার দায়িত্ব) কাজে নিযুক্ত করেন। জিলাদারী কাজ করে বহু অর্থ সঞ্চয় করে কিছু সম্পত্তি কেনেন তিনি। লালগোলাতে দুই ভাইয়ের শ্রীবৃদ্ধি হয় বলে এই গ্রামের নাম দেওয়া হয় শ্রীমন্তপুর। এ ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল লালগোলা রাজ এস্টেটের। লালগোলা রাজ পরিবারের উন্নতি সর্বাপেক্ষা যাঁর হাত ধরে হয়েছিল, তিনি হলেন রাজা রাও রামশঙ্কর রায়। লালগোলা রথযাত্রার প্রচলনও তাঁরই হাত ধরে। সময়টা ১২২৯ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৮২৩ সাল, রাজা রাও রামশঙ্কর রায় একটি বিশাল কাঠের কারুকার্যময় রথ তৈরি করান।
সেই রথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রতি দিকে ত্রিশ হাত, উচ্চতা ছিল একশো হাত। তার পরের বছর ১৮২৪ সালে এই রথযাত্রার সূচনা হয়। কুলদেবতা দধীবামন দেব যাঁর অপর নাম সুদর্শন দেব তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য এই যাত্রার প্রচলন। বর্তমান রাজবাড়ির (যেটি এখন মুক্ত সংশোধনাগার) ভেতরে নাট মন্দিরের পেছনে দোতলায় উত্তর দিকে দধীবামন দেবের মন্দির। আগে সেই মন্দির থেকে দধীবামন দেবকে পুজো করে লাল শালুতে করে ঢেকে নিয়ে এসে রথে তোলা হত। এখন তাঁর নিবাস ১৩৩১ বঙ্গাব্দে লালগোলা রাজ পরিবারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, জুম্মন শেখ দ্বারা নির্মিত নারায়ণ মন্দিরে। সেই মন্দির থেকে দধীবামন দেবকে যাঁর অপর নাম নারায়ণও বটে, একই নিয়মে এনে রথে তোলা হয়। ভক্তরা দড়িতে হাত দিলে রথ বিকেলে রাজপথে বের হয় এবং এক কিলোমিটার দূরে মাসির বাড়িতে যেটি রাজপরিবার দ্বারা নির্মিত নাট মন্দির, সেখানে পৌঁছয়। কাঠের রথটি বহুদিন পর ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকলে রাজা রাও রামশঙ্করের পুত্র রাও মহেশ নারায়ণ রায় একটি সুদৃশ্য রথ নির্মাণ করান লোহা ও পিতল দিয়ে। সেই রথ লালগোলার গর্ব হিসেবে চিহ্নিত, যদিও তাঁর জৌলুস অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে। তাও আজও এই পিতলের রথ লালগোলার ঐতিহ্য বহন করছে।
লালগোলা দধীবামন দেবের মাসির বাড়ি লালগোলা রথবাজার নামে যা আজও প্রসিদ্ধ। এই মন্দিরে সেই সময় লালগোলার রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে মহা ধুমধামের সঙ্গে পুজোর আয়োজন করা হত, এবং ছাপ্পান্ন ভোগের আয়োজন ছিল। কালের সঙ্গে সঙ্গে রাজপাট সমাপ্ত হয় ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়। তার আগে থেকেই মন্দির ভগ্নদশা প্রাপ্ত হতে শুরু করে, সেই সময় লালগোলার বেশ কিছু সাংস্কৃতিক মনোভাবাপন্ন মানুষ ১৯৬৬ সালে মন্দির প্রাঙ্গণে স্থাপন করেন লালগোলা সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ। সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ বহু নাটক লালগোলার মানুষকে উপহার দেয়। এঁদের মধ্য উল্লেখযোগ্য সাধন সরকার,অবনী বন্দ্যোপাধ্যায়, সর্বানী রাহা প্রমুখ। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই মন্দির প্রাঙ্গণ বহু নাটকের মহড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখরিত থাকত। কিন্তু মন্দিরের দশা হয়ে যাচ্ছিল ভগ্নপ্রায়। সেই সময় লালগোলার কিছু উদ্যোগী যুবক মন্দিরটির দায়িত্ব কাঁধে নেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তাঁরা মন্দিরের সঙ্গে জুড়ে যান। এঁদের মধ্যে কয়েক জন হলেন, সুমিত সরকার, ডোমন হরিজন, বরুন দাস, রঞ্জিত দাস, সন্দীপ চক্রবর্তী, উত্তম পাল, সাগর দাস প্রমুখ। তাঁরা মন্দিরের দায়িত্ব নিয়ে ২০০৩ সালের মধ্যে মন্দিরর ভগ্ন ছাদ ও দেওয়াল ভেঙে তার পুনর্নির্মাণ করান। দধীবামন দেবের পুজোর একটি খরচ রাজ এস্টেট আজও বহন করে। গত পাঁচ বছর ধরে লালগোলার মানুষের দ্বারা নির্মিত কমিটি পুনরায় ছাপান্ন ভোগ ও খিচুরি প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা করছে।
এ বার আসি এই মন্দিরের সেবাইয়েতদের বিষয়ে। মন্দিরের বর্তমান সেবাইয়েত রামচন্দ্র পাঠক ও তাঁর পুত্ররা। রামচন্দ্র পঠকের থেকে জানা যায় উনি ১৯৬২ সালে এই মন্দিরের সেবাইয়েত হন। তার আগে তাঁর দাদা শ্বশুর রামসুখ তিওয়ারি বংশানুক্রমিক ভাবে এই মন্দিরের সেবাইতের দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরে রামচন্দ্র পাঠক আজ পর্যন্ত সেবাইত নিযুক্ত ও তাঁকে সহায়তা করেন তাঁর পুত্র গিরিধারী পাঠক ও অন্যান্যরা।
লালগোলা রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসত। পূর্বে উল্লিখিত মাসির বাড়ি যা নাটমন্দির নামেও পরিচিত তাকে কেন্দ্র করে প্রায় তিন মাস ধরে একটি বিশাল বাজার বসত যা রথবাজার নামে খ্যাত। সেই বাজারে মালদহ, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্ত ও পদ্মার ওপার থেকে বহু ব্যবসায়ীর সমাগত হতো। চলত বেচাকেনা, শক্ত হতো লালগোলার অর্থনীতি। রথবাজারে মাসির বাড়ি যা নটরাজ মন্দির নামে পরিচিত, তার চারপাশ ঘিরে বসত বিস্তীর্ণ বাজার, মূল বাজার ছাড়া আলাদা ভাবে এ বাজার বসত। এক দিকে সারিবদ্ধ ভাবে বসত বাহারি পাখার বাজার, এপার ওপার বাংলার বহু পাখার ব্যবসায়ী আসতেন তাঁদের সম্ভার নিয়ে। রথবাজারের পূর্ব দিকে বসত বাসনের বাজার, অধুনা বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ থেকেই শুধুমাত্র এই বাসনের সম্ভার নিয়ে হাজির হতেন ব্যবসায়ীরা। বাজারের পশ্চিম প্রান্তে রঘুনাথগঞ্জ থানার অন্তর্গত দয়ারামপুর গ্রাম থেকে আসতেন ময়রারা। উৎকৃষ্ট মিষ্টি বিক্রি হতো সেই বাজারে। ভেতরে প্রায় তিনটে সারিতে পর পর বসতো মণিহারির দোকান। তিন মাস ধরে চলত কেনাবেচা। মানুষের ভিড় পড়ত উপচে। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই লালগোলা নদী বন্দর
হিসেবে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে বড় বড় নৌকায় তেল, ঘি, গুড়, পাথরের শিল নোড়া ও থালা বাসন এখানে আসত। ওপারের পাবনা, ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল থেকে পাট, ধান, শুটকি মাছের সম্ভার বহন করে আনত বড় বড় নৌকা। লালগোলা ঘাটেই হতো আদান-প্রদান। এ ভাবেই ক্রমশ লালগোলার শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে।
তথ্য সহায়তা: ১) মহামানব জাতক- সুধাকর চট্টোপাধ্যায়।
২) মুর্শিদাবাদ কাহিনী- নিখিলনাথ রায়।
৩) লালগোলার নারায়ণ মন্দিরের পুরোহিত এবং কয়েক জন প্রবীণ ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার।
সুমনকুমার মিত্র
গবেষক, মুর্শিদাবাদ জেলা ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy